সে ইতস্তত করে বলল, না।
‘কোন কিছুই মনে নেই?’
সে চুপ করে রইল। আমি বললাম, যদি মনে থাকে আমাকে বল। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।
সে নিচু গলায় বলল, পাগল হবার আগের সময়টার কথা মনে আছে।
‘বল শুনি।‘
‘আমি আমার পড়ার ঘরে বসেছিলাম। হঠাৎ দেখলাম ঘরটা ছোট হয়ে যাচ্ছে। দেয়ালগুলো আমার কাছে চলে আসছে। তখন ভয় পেয়ে আমি একটা বিকট চিৎকার দেই।‘
‘এর পরের কথা তোমার আর কিছু মনে নেই?’
‘না। শুধু মনে আছে–সারাক্ষণ একটা কুকুরের মুখ দেখতাম। মুখটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকত।‘
‘কি রঙের কুকুর?’
‘ঘিয়া রঙের। কুকুরটার শরীর ছোট কিন্তু মুখটা অনেক বড়। গরুর মুখের মত বড়।‘
‘আর কিছু তোমার মনে নেই?’
‘না।‘
ইংলিশম্যান রসায়ন বিভাগে দুই বছর পড়াশোনা করল। থার্ড ইয়ারে উঠে সে আবার পাগল হয়ে গেল। একদিন ক্লাসে এসে উপস্থিত হল সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়। ভয়াবহ ব্যাপার! আমি তাকে ডেকে আমার ঘরে নিয়ে গেলাম। আমি বললাম, তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ?
সে হেসে বলল, হ্যাঁ, তুমি হুমায়ূন।
আমি একটি এপ্রন এনে তাকে পরতে দিলাম। সে কোন আপত্তি না করেই এপ্রন। পরল। আমি বললাম, তুমি যে কোন কাপড় ছাড়া ডিপার্টমেন্টে এসেছ–এটা কি ঠিক হয়েছে? তোমার বন্ধুরা খুব লজ্জা পাচ্ছে। কেউ কেউ ভয়ও পাচ্ছে। তুমি কি তা বুঝতে পারছ না?
‘পারছি।‘
‘তুমি অসুস্থ।সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ডিপার্টমেন্টে আসার তোমার কোন দরকার নেই। আর যদি আস কাপড় পরে আসবে, কেমন?’
ইংলিশম্যান ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কাপড় পরলে সে রাগ করে।
‘কে রাগ করে?’
‘কুকুরটা রাগ করে।‘
‘কোথায় কুকুর?’
‘এইখানে নাই। রাস্তায় গেলেই আসে।‘
‘কুকুর রাগ করুক আর যাই করুক–তুমি সবসময় কাপড় পরে থাকবে।‘
‘আচ্ছা।‘
ইংলিশম্যানের এক ভাই পড়তো ফার্মেসী বিভাগে। তাকে খবর দিলাম। বেচারা কাঁদতে কাঁদতে বড় ভাইকে বাসায় নিয়ে গেল। সমস্যার শেষ হল না। এটা ছিল সমস্যার শুরু। ইংলিশম্যান দু-তিন দিন পর পরই ডিপার্টমেন্টে আসতে শুরু করল। এসেই সে খোঁজে আমাকে। ব্যাকুল হয়ে ডাকে–হুমায়ূন, হুমায়ুন। আমি একদিন তার ভাইকে ডেকে ধমকে দিলাম। এসব কি! অসুস্থ একটা ছেলেকে আটকে রাখতে হবে। তারা ছেড়ে দিচ্ছে কেন?
আমি তখন বাবর রোডের বাসায় থাকি। এক ছুটির দিন ভোরবেলায় সে আমার বাসায় উপস্থিত। আগের মত অবস্থা। গায়ে কোন কাপড় নেই, শুধু মাথায় একটা রুমাল বাঁধা। কথাবার্তা খুব স্বাভাবিক। আমি বললাম–বাসা চিনলে কিভাবে?
সে হাসল।
আমার বাসা তার চেনার কোনই কারণ নেই। আগে কোনদিন বাসায় নিয়ে আসিনি। ডিপার্টমেন্ট থেকে ঠিকানা জোগাড় করে আসবে, তাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেউ তাকে ঠিকানা দেবে না।
আমি তাকে বসার ঘরে এনে বসালাম। নিজের একটা পুরানো প্যান্ট পরিয়ে দিলাম। সে আপত্তি করল না। বরং আগ্রহ করে পরল। চা খেতে দিলাম। চা খেল।
আমি বললাম, ঠিকানা কোথায় পেলে?
ইংলিশম্যান বলল, ঠিকানা লাগে না। আমি আতংকিত বোধ করলাম। সে তো এখন রোজই এখানে আসবে। আমাকে অস্থির করে মারবে।
যা ভাবলাম তাই ঘটল। ইংলিশম্যান কয়েকদিন পরপরই আসে। তবে বিরক্ত করে না। প্রথম দিন সোফার যে জায়গায় বসেছিল রোজ এসে সেই জায়গাটায় বসে। চা দিলে খায়। ঘণ্টা দুই বসে থেকে চলে যায়। আমি তাকে অনেক বুঝালাম–রোজ এভাবে আসা ঠিক না। অনেক সমস্যা হয়। প্রতিবারই সে আন্তরিক ভঙ্গিতে বলে–আর আসব না। কিন্তু আবারো আসে। ইংলিশম্যানের যন্ত্রণায় অবস্থা এমন হল যে আমি বাসা ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবতে লাগলাম। নতুন কোন জায়গায় গিয়ে উঠব যাতে সে আমার খোঁজ না পায়। সেটাও সম্ভব হল না। আমার তখন আর্থিক সামর্থ্য নেই বললেই চলে। কোন রকমে জীবন ধারণ করে আছি। নতুন বাসা ভাড়া নেয়ার অবস্থা। নেই। বাবর রোডের যে বাসায় থাকি তা সরকারী বাসা। শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে বরাদ্দ দেয়া। নামমাত্র ভাড়া। আমি মাটি কামড়ে সেখানেই পড়ে রইলাম। ইংলিশম্যান নিয়তির মতো হয়ে গেল। ধরেই নিলাম সে আসবেই। আসেতই থাকবে। হলও তাই।
পাগলদের প্রতি আমাদের সমাজ খুব নিষ্ঠুর আচরণ করে। এই নিষ্ঠুরতা সবচে’ বেশি দেখা যায় শিশুদের বেলায়। যে কোন কারণেই হোক শিশুরা পাগল সহ্য করতে পারে না।–ইংলিশম্যান যতবার আমার এখানে এসেছে ততবারই শিশুদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে। শিশুরা তাকে তাড়া করে। পাথর ছুঁড়ে। বড়রা তাদের আটকায় না। দূরে দাঁড়িয়ে হাসে। মজা দেখে।
ইংলিশম্যানের উপদ্রব হঠাৎ একদিন বন্ধ হয়ে গেল। চার মাস কেটে গেল, তার দেখা নেই। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। আশংকা পুরোপুরি গেল না। এটা হয়ত সাময়িক বিরতি। আবার আসতে শুরু করবে। জীবন অর্থহীন করে দেবে। সে এল না। দেখতে দেখতে এক বছর কেটে গেল। মানুষ অস্বস্তিকর স্মৃতি মনে রাখে না। আমিও মনে রাখলাম না। ইংলিশম্যানের কথা ভুলে গেলাম।
এক শীতের সকালের কথা। ছুটির দিন। নিউমার্কেটে এসেছি–কাগজ কিনব। হঠাৎ দেখি ইংলিশম্যান। সুন্দর একটা বাদামী রঙের স্যুট পরে দাঁড়িয়ে আছে। স্যুটটায় তাকে খুব মানিয়েছে। তার গায়ের রঙ ফর্সা। সেই রঙ যেন আরো খুলেছে। মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চোখে চশমা। চশমার ফ্রেমটাও সুন্দর। ইংলিশম্যানের হাতে একটা শপিং ব্যাগ, অনেক কেনাকাটা করেছে বলেও মনে হল।