রাত একটার দিকে গুলতেকিন শাল গায়ে দিয়ে বাইরে এসে বলল, চল, তোমার সমুদ্র-জোছনা দেখে আসি।
আমি আমার স্ত্রীর এই বাক্যটির জন্যে তার পূর্বের এক হাজার অপরাধ ক্ষমা করে দিলাম।
সমুদ্রের কাছে কিন্তু যাওয়া হল না। কটেজের বাইরে পা দিয়েই এক ধরনের অতিপ্রাকৃত দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম। দৃশ্যটি বর্ণনা করার চেষ্টা করি–
আমাদের কটেজের ডানপাশে অনেকখানি খালি জায়গা। জায়গাটার এক অংশে বেশকিছু বাশ পোঁতা। বাঁশগুলি সুতলি দিয়ে বাঁধা। সেই সব সুতলিতে রঙিন কাগজ, ছেঁড়া কাগজ, কাপড়ের টুকরা সাজানো। বোঝাই যাচ্ছে, যে সাজিয়েছে সে খুব যত্ন করে সাজিয়েছে। কিন্তু সেই সাজানোয় সুন্দরের চেয়ে অসুন্দর অনেক বেশি। তাকালেই মনে এক ধরনের ধাক্কা লাগে।
সাজানোর কাজটি যে করেছে তাকে আমরা এখন দেখলাম। খালি গায়ে রোগা লম্বা একজন মানুষ। তার জ্বলজ্বলে চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে–মানুষটা স্বাভাবিক। নয়। আস্তাকুঁড় থেকে সে রাজ্যের ময়লা নিয়ে এসেছে। ময়লা থেকে বেছে বেছে রঙিন কাগজ নিয়ে সুতলিতে সাজাচ্ছে। কাজটা সে মোটেই হেলাফেলার সঙ্গে করছে না। কয়েকটা রঙিন কাগজের টুকরা বের করে সে প্রথমে তার সামনে রাখে। দীর্ঘ সময় কাগজের টুকরাগুলির দিকে তাকিয়ে থেকে কি যেন ভাবে। তারপর একটা একটা করে কাগজ লাগায়। লাগিয়ে দূর থেকে, কাছে থেকে নানানভাবে সে পরীক্ষা করে।
আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি, পাগলদের খুব ভদ্র ভঙ্গিতে কিছু জিজ্ঞেস করলে তারা জবাব দেয়। ভালভাবেই জবাব দেয়। আমি শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি করছেন?
লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকাল। আমি আবার বললাম, আপনি কি করছেন?
লোকটি চিটাগাং-এর কথ্য ভাষায় যা বলল তা হল–তুমি কি দেখতে পারছ না। আমি কি করছি?
আমার প্রশ্নটা ছিল বোকার মত। উত্তর শুনে খানিকটা হকচকিয়ে যেতে হল। আমি দ্বিতীয় প্রশ্ন করলাম–সাজাচ্ছেন কেন?
লোকটি সেই প্রশ্নের জবাব দিল না। গভীর মনোযোগে কাগজ বাছতে লাগল। সমুদ্র-জোছনার চেয়ে লোকটির কাণ্ডকারখানা আমার কাছে অনেক আকর্ষণীয় মনে হল। আমি কটেজের বারান্দায় ফিরে গেলাম। গভীর আগ্রহে পাগলের কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলাম। কটেজের নাইট গার্ড আমাকে বলল–এই পাগল অনেকদিন থেকে কক্সবাজারে আছে। সারাদিন সে রঙিন কাগজ খুঁজে বেড়ায়। রাত বারোটার পর থেকে সাজাতে শুরু করে। সাজানো শেষ হলে কয়েকটা ইট বিছিয়ে আগুন জ্বালায়। সেই আগুনে নিজের খাবার নিজেই রান্না করে খায়। খাওয়া শেষ হবার পর নিজের শিল্পকর্মের সামনে মূর্তির মত বসে থাকে। রাত এই ভাবে কাটিয়ে ভোর হবার আগে আগে আবার বের হয়ে পড়ে রঙিন কাগজের খোঁজে।
নাইটগার্ড যা বলল সবই ঘটতে দেখলাম। যা সে বলেনি বা বলতে ভুলে গেছে তাও দেখলাম। লোকটি যে তার শিল্পকর্ম মুগ্ধ হয়ে দেখে তা না, শিল্পকর্মের সামনে কিছুক্ষণ আত্মভোলা ভঙ্গিতে নাচে।
এই লোকটির অতীত ইতিহাস কি?
কেন সে রঙিন কাগজে ঘর সাজায়? কি ভাবে সে? এই রহস্য কোনদিনও জানা হবে না। জগতের অনেক রহস্যের মত এই রহস্যও ঢাকা থাকবে অনেক দিন।
পাগলদের প্রতি আমার আগ্রহ এবং কৌতূহল সীমাহীন। এদের সবারই আলাদা নিজস্ব লজিক আছে। সেই লজিকের কারণে কাউকে কাউকে দেখা যায় গভীর একনিষ্ঠতায় ট্রাফিক কনট্রোল করছে, আবার কাউকে কাউকে দেখা যায় রঙিন কাগজ জড়ো করে বিচিত্র শিল্পকর্ম তৈরি করছে।
ঢাকা কলেজে যখন পড়ি তখন আমার ক্লাসেরই এক ছাত্রের সঙ্গে আমার। খানিকটা ঘনিষ্ঠতা হয়। চমঙ্কার ছেলে। ভদ্র, বিনয়ী, মেধাবী। দোষের মধ্যে একটিই–বড় বেশি ইংরেজি বলে। আমরা তার নাম দিয়েছিলাম ইংলিশম্যান। ইন্টারমিডিয়েট সে আমার সঙ্গেই পাস করল। স্টার মার্কস পেল। তারপর আর তার সঙ্গে আমার। কোন যোগাযোগ রইল না। দীর্ঘদিন পরের কথা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করছি। হঠাৎ অবাক হয়ে দেখি, আমার ছাত্রদের মাঝে মাথা নিচু করে ইংলিশম্যান বসে আছে। আমি পড়ানো বন্ধ করে বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি অমুক না?
সে স্নান গলায় বলল, ইয়েস স্যার।
‘ক্লাস শেষ হবার পর তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে।‘
‘জ্বি, আচ্ছা স্যার।‘
ক্লাসের শেষে সে আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। বেচারা লজ্জায় মরে যাচ্ছে। চেয়ারে বসতে বললাম, কিছুতেই বসবে না। খুবই অস্বস্তিকর অবস্থা। তার কাছ থেকে যা জানলাম তা হল–ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর পর তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলে। শেষ পর্যায়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করানো হয়। এখন সে সুস্থ। আবার পড়াশোনা শুরু করেছে।
আমি তাকে যথেষ্ট উৎসাহ দিলাম। দীর্ঘদিন পার করে আবার পড়াশোনা শুরু করার সৎসাহস তুচ্ছ করার বিষয় নয়। আমি তাকে বললাম, কখনোই আমাকে স্যার ডাকবে না। আগের মত হুমায়ুন করেই ডাকবে।
আমি দূরত্ব দূর করতে চাইলাম, দূর হল না। রাস্তা ঘাটে দেখা হলে অন্য ছাত্রদের মতই বিনীত ভঙ্গিতে সে আমাকে সালাম দেয়। ক্লাসে মাথা নিচু করে বসে থাকে। আমি প্রায়ই আমার রুমে তাকে ডেকে নিয়ে আসি চা খাবার জন্যে। নানান ধরনের গল্প করার চেষ্টা করি। গল্প জমে না। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, পাগল হবার সময়ের কথা কি কিছু মনে আছে?