আমি বিরস গলায় বললাম, গান। ভদ্রলোক গান ধরল–বিদায়ের গান :
“আমার যাবার সময় হল দাও বিদায়।”
গাইতে গাইতে তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। আশ্চর্যের ব্যাপার, তিনি গাইলেন খুব সুন্দর করে। চারপাশে লোক জমে গেল। আমার নিজের চোখেও পানি এসে গেল।
.
পরীক্ষা প্রসঙ্গে আরেকটি স্মৃতির কথা বলি। সঙ্গত কারণেই কলেজের নাম উল্লেখ করছি না।
কেমিস্ট্রির অনার্স ব্যবহারিক পরীক্ষা। পাঁচদিন ধরে চলছে। কঠিন পরীক্ষা। ছাত্র ছাত্রীদের নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। এর মধ্যে একজনকে দেখে খুব মায়া লাগল। অল্প বয়েসী একটি মেয়ে–খুব শিগগিরই মা হবে। শারীরিক অস্বাভাবিকতার কারণে সে লজ্জিত এবং সংকুচিত। অন্যদের মত সে পরিশ্রমও করতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর পর টুলে বসে তাকে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। পরীক্ষার কাজগুলিও সে ঠিকমত পারছে বলে মনে হচ্ছে না। আমি কলেজের একজন ডেমনস্ট্রেটরকে বললাম, আপনি ঐ মেয়েটিকে সাহায্য করুন। ওকে বলুন চেয়ারে বসে কাজ করতে। তাকে নিচু একটা টেবিল এনে দিন। যন্ত্রপাতিগুলি টেবিলে রেখে সে কাজ করুক। কোন অসুবিধা নেই।
ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর হয় মৌখিক পরীক্ষা। সবাই মৌখিক পরীক্ষা দিল, শুধু মেয়েটি দিল না। ইন্টারন্যাল একজামিনার আমাকে জানালেন–আজই মেয়েটির একটি বাচ্চা হয়েছে বলে সে পরীক্ষা দিতে পারেনি। ব্যাপারটা বেশ দুঃখজনক। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে মৌখিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত হলে ব্যবহারিক পরীক্ষায় পাস হবে না। ব্যবহারিক পরীক্ষা ফেল মানে অনার্স পরীক্ষায় ফেল।
ভাইভা শেষ হল। রেজাল্ট শীট তৈরি করতে করতে রাত দশটা বেজে গেল। সীল গালা আনা হল। রেজাল্ট শীট খামে ঢুকিয়ে সীল গালা করা হবে। তখন আমি বললাম, এক কাজ করলে কেমন হয়? চলুন, আমরা সবাই মিলে মেয়েটার বাসায় চলে যাই। ভাইভা নিয়ে আসি।
কেমিস্ট্রির চেয়ারম্যান সাহেব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না। আমি বললাম, মেয়েটার বাসা কোথায় জানেন?
‘বাসা বের করা যাবে তবে শহরে থাকে না। অনেক দূরে থাকে। আপনি কি সত্যি : যেতে চান?’
‘হ্যাঁ চাই।‘
‘ইউনিভার্সিটির কোন সমস্যা যদি হয়!’
‘আমরা অন্যায় তো কিছু করছি না। বিশেষ পরিস্থিতির কারণে–একজামিনেশন। বোর্ডের সব মেম্বার পরীক্ষার্থীর বাসায় উপস্থিত হচ্ছি।‘
‘এরকম কখনো কি করা হয়েছে?’
‘আমার জানামতে করা হয়নি। তবে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে একজন ছাত্রের ভাইভা নেয়া হয়েছে। চলুন যাই।‘
‘ইউনিভার্সিটি যদি কোন সমস্যা করে?’
‘সেই দায়িত্ব আমার। চলুন যাই।‘
মেয়েটির বাড়ি শহর থেকে নয়-দশ মাইল দূরে। রিকশা করে, ঝাঁকুনি খেতে খেতে যাচ্ছি। রাস্তা কারোর চেনা নেই। জিজ্ঞেস করে করে এগুতে হচ্ছে। রাত বারটার দিকে আমরা চারজন শিক্ষক তার বাসায় উপস্থিত হলাম। চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেল। মেয়ের বাবা এবং মা দুজনেই আনন্দে কাঁদছেন। আশেপাশের সব মানুষ খবর পেয়ে উপস্থিত হয়েছে। এমন একটা ব্যাপার যে ঘটতে পারে তা কেউ কল্পনাই করেনি। মেয়ের স্বামী সাইকেল নিয়ে উধ্বশ্বাসে শহরে ছুটেছে। মিষ্টি আনতে হবে।
আমরা ভাইভা নিতে মেয়ের ঘরে ঢুকলাম। মেয়েটি উজ্জ্বল মুখে শুয়ে আছে। তার পাশে ছোট্ট একটি বাচ্চা। আমরা মেয়েটির ভাইভা নিতে এসেছি শোনার পর থেকে সে নাকি খুব কাঁদছিল, এখন চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়েছে। ভাইভা শুরু হল। মেয়েটা বলল, স্যার, আমার বাচ্চাটাকে আগে একটু দেখুন।
আমি বললাম, তোমার বাচ্চা দেখতে তো আসিনি। ভাইভা নিতে এসেছি। আচ্ছা, ঠিক আছে, দেখি তোমার বাচ্চা!
মেয়েটি বাচ্চার মুখের উপর থেকে চাঁদর সরিয়ে দিল।
বাচ্চা ঘুমুচ্ছে। কি সুন্দর ছোট্ট একটা মুখ। মাথা ভর্তি রেশমী চুল। কি ছোট্ট, কি পাতলা ঠোঁট।
মেয়েটির ভাইভা খুব খারাপ হল। সে অধিকাংশ প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারল না। কিন্তু তাতে সে মোটেও নার্ভাস হল না। সহজ গলায় বলল, স্যার, এবারে অনার্স পরীক্ষা আমি পাস করতে পারব না। থিওরী খুব খারাপ হয়েছে। পড়াশোনা করতে পারিনি। কিন্তু আমার মনে কোন আফসোস নেই। আপনারা পরীক্ষা নিতে বাড়িতে এসেছেন এইটা আমার জন্য অনেক। আমার মত ভাগ্যবতী মেয়ে এই পৃথিবীতে নেই। বলতে বলতে মেয়েটি কাঁদতে লাগল।
ঘটনার বর্ণনা এইখানে শেষ করে দিলে পাঠকরা আমার সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারণা পাবেন। তাঁরা মনে করবেন–হুমায়ূন আহমেদ মানুষটা খুব হৃদয়বান। একজন। ছাত্রী যেন পরীক্ষায় পাস করতে পারে তার জন্যে রাতদুপুরে কত ঝামেলা করেছেন।
ব্যাপার মোটেই তা নয়। নানান সমস্যার কারণে অনেকেই পরীক্ষা দিতে পারে না, পরের বার পরীক্ষা দেয়। এটা তেমন কোন বড় ব্যাপার না। মেয়েটি পরীক্ষায় পাস। করতে পারবে না এ নিয়ে বিচলিত হয়ে আমি গভীর রাতে তার বাড়িতে উপস্থিত হইনি। এই কাণ্ডটি করেছি সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। আমরা ভাইভা নিতে গভীর রাতে ছাত্রীর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছি এই অদ্ভুত ঘটনায় ছাত্রী এবং তার আত্মীয়স্বজনের মনে কি অবস্থার সৃষ্টি হয় তাই আমি দেখতে চেয়েছিলাম। একদল অভিভূত মানুষ দৈখে আমি আনন্দ পেতে চেয়েছিলাম। আমি গিয়েছিলাম সম্পূর্ণ আমার নিজের আনন্দের। জন্যে। মেয়েটি সন্তানের জন্ম দিয়ে আমাকে গাঢ় আনন্দ পাবার একটি সুযোগ করে দিয়েছিল। তাকে এবং তার বাচ্চাটিকে ধন্যবাদ।
মাসাউকি খাতাঁওরা
মধ্যবিত্তদের জীবনে উত্তেজনা সৃষ্টির মতো ঘটনা বড় একটা ঘটে না। তাদের জীবনযাত্রা খাওয়া ঘুমানো এবং টিভি দেখার মধ্যেই মোটামুটি সীমাবদ্ধ। কিন্তু আমার ছোটভাইয়ের বাসায় ব্যতিক্রম হলো। তাদের বাসায় উত্তেজনা সৃষ্টির মতো একটা ঘটনা ঘটার উপক্রম হলো। শুনলাম, এক জাপানি যুবক নাকি তার বাসায় একমাস থাকবে। জাপান-বাংলাদেশ টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের সে একজন কর্মী, বাংলাদেশের গ্রামে দু’বছর কাটাবে। তবে পোস্টিং হওয়ার আগে বাংলাদেশের কোনো এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সঙ্গে তাকে এক মাস কাটাতে হবে, যাতে সে আমাদের রীতি-নীতি, আচার-আচরণ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পায়।