‘এই ধরুন, একটা-দুটা।‘
‘কি কাজ এত রাতে?’
‘ইয়ে মানে–একটু তা-টাস খেলি।‘
‘পয়সা দিয়ে খেলেন?”
‘আরে না। পয়সা পাব কোথায়? মাঝে মধ্যে খেলাটা ইন্টারেস্টিং করার জন্যে খুব অল্প স্টেকে খেলা হয়। নিতান্তই নির্দোষ আনন্দ।‘
ভদ্রলোক নির্দোষ আনন্দের সন্ধানে আমাকে তালা দিয়ে চলে গেলেন। বাড়ি থেকে বেরুবার একটি মাত্র দরজা, সেটি তালাবন্ধ। এই অবস্থায় সারাক্ষণ মনে হয় আগুন লেগে গেলে কি হবে? বেরুব কি করে?
দুশ্চিন্তায় অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম হল না। তন্দ্রামত আসে, আবার ভেঙে যায়। আমি ঘড়ি দেখি। রাত দুটার সময় শুরু হল ভূতের উপদ্রব। কলঘরে পানি পড়বার শব্দ হচ্ছে। রান্নঘরে হাড়ি-কুড়ি নড়ছে। ঝপাং করে বাড়ির টিনের ছাদে কি যেন লাফিয়ে পড়ল। সারা বাড়ি কেঁপে উঠল। নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম। ছাদে ঝাঁপ দিয়ে যা পড়েছে তা আর কিছুই না, বানর। কিছুক্ষণ পর স্পষ্ট শুনলাম বারান্দায় চটি পায়ে কে। যেন হাঁটছে। একবার এ-মাথায় যাচ্ছে, আরেকবার ও-মাথায়। ঘরের বাতি জ্বালিয়ে বিছানায় বসে রইলাম। প্রচন্ড বাথরুম পেয়েছে, বাথরুমে যাবার সাহস নেই। সেখানে কল থেকে পানি পড়ছে, পানি পড়া বন্ধ হচ্ছে। আবারো পানি পড়ছে। ঘড়িতে রাত বাজে তিনটা। এত ভয় জীবনে পাইনি।
শিক্ষক ভদ্রলোক রাত তিনটার দিকে নির্দোষ আনন্দ শেষ করে ফিরলেন। আমি
তাকে ঘটনাটা বললাম, তিনি নিতান্তই স্বাভাবিকভাবে বললেন, ও কিছু না, জ্বীন।
আমি বললাম, জ্বীন মানে?
‘এ বাড়িতে একটা জ্বীন থাকে। দুষ্ট প্রকৃতির। আমাদের কিছু বলে না তবে বাইরের কেউ একা থাকলে যন্ত্রণা করে। তবে কারো কোন অনিষ্ট করে না।‘
‘এসব কি বলছেন ভাই?’
‘বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার। আমি নিজেও বিশ্বাস করি না। লোকে যা বলে আপনাকে বললাম। আমার স্ত্রী জ্বীনটাকে কয়েকবার দেখেছেন। ছোট সাইজ। গা ভর্তি পশম।
‘জ্বীনের গা ভর্তি পশম?’
‘জি। খুব নরম।‘
‘আপনি হাত দিয়ে দেখেছেন যে নরম?’
‘আমি হাত দেইনি। আমার স্ত্রী হাত দিয়েছেন। বিড়ালের পশমের মত পশম, তবে আরো সফট।‘
বাকি যে ক’রাত ছিলাম, আমিও ভদ্রলোকের সঙ্গে নির্দোষ আনন্দে যেতাম। উনি হাইড্রোজেন নামের একটা খেলা খেলতেন। আমি পাশে বসে ঝিমাতাম।
.
বরিশাল বি এম কলেজে পরীক্ষা নিতে গিয়েও বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমার থাকার জায়গা হয়েছে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের অফিসে। একটা চৌকি পেতে থাকার ব্যবস্থা। রাতের বেলা ক্যাম্পাস ফাঁফা হয়ে যায়–কোথাও জনমানব নেই। আমি একা বাতি জ্বেলে জেগে বসে থাকি, ভয়ে ঘুম আসে না। গভীর রাতে জানালায় টুক করে। শব্দ হল। আমি ভয়ে শক্ত হয়ে গেছি–আস্তে আস্তে জানালা খুলছে। আমি চিৎকার করে বললাম, কে?
জানালা খোলা বন্ধ হল, তবে সামান্য যা ফাঁক হয়েছে সেই ফাঁক দিয়ে লিকলিকে কালো একটা হাত ঘরের ভেতর ঢুকতে লাগল। মনে হল ঘরে একটা সাপ ঢুকছে। সাপের মাথায় পাঁচটা আঙুল। আমার ধারণা হল–এক্ষুনি বোধহয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। একধরনের ঘোরের মধ্যে বললাম, কে?
বাইরে থেকে উত্তর এল–স্যার আমি।
‘আমিটা কে?’
‘হুজুরের কাছে আমার একটা দরখাস্ত।‘
আস্তে আস্তে হাতের মুঠি খুলে গেল। টপ করে হাত থেকে একটা কাগজ পড়ল। হাত উধাও হয়ে গেল। সাহস সঞ্চয় করে কাগজ কুড়িয়ে নিলাম। সত্যি সত্যি দরখাস্ত! কেমিস্ট্রি বিভাগের জনৈক বেয়ারা দরখাস্ত করেছে আমার কাছে। বিভাগের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মত হল। পরের রাতেও একই ব্যাপার। চেয়ারম্যান সাহেবকে জানালাম। তিনি তাকে ডেকে এনে অনেক ধমকাধমকি করলেন। কঠিন গলায় বললেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাও ভাল কথা, কর। দিনের বেলা কর। রাতদুপুরে উনাকে ভয় দেখাচ্ছ কেন? ধমকে কাজ হল না। পরের রাতে সে আবার এল। সব মিলিয়ে পাঁচ রাত ছিলাম। প্রতি রাতেই এই কাণ্ড ঘটেছে।
পরীক্ষা নিতে গিয়ে ভয়ের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে মজার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। পটুয়াখালি কলেজে পরীক্ষা নিতে গিয়ে এক গায়কের পাল্লায় পড়েছিলাম। সেই গায়কের গানের গলা ছাড়া আর সবই আছে। হাজার হাজার গান তিনি জানেন, সুর। জানেন শুধু গলাটা বেসুরো। তিনি গানের পর গান গেয়ে যেতেন। আমি একমনে প্রার্থনা করতাম–হে আল্লাহ পাক! এই গানের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও। তোমার কাছে। আপাতত আর আমি কিছুই চাই না।
গায়ক ভদ্রলোককে অসংখ্যবার আমার বলার ইচ্ছা হয়েছে, ভাই, আমাকে ক্ষমা করুন। এই অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। তখন বয়স ছিল অল্প, মন ছিল নরম। কঠিন সত্যি কথা বলা সম্ভব হয়নি। পটুয়াখালি থেকে পরীক্ষা শেষ করে চলে আসবার দিন দেখি তিনি গাদা ফুলের একটা মালা হাতে লঞ্চঘাটে উপস্থিত। আমি শুকনো গলায় বললাম, আপনার গান খুব মিস করব। চর্চা রাখবেন। গান-বাজনা চর্চার ব্যাপার।
‘স্যার আপনি কি আমার গান শুনে আনন্দ পেয়েছেন?’
‘জি পেয়েছি।‘
গায়ক ভদ্রলোক শুধু গাদা ফুলের মালা নিয়েই আসেননি। ছোট্ট একটা ফ্লাস্ক এনেছেন। ফ্লাস্ক ভর্তি চা।
‘আপনি চা পছন্দ করেন। বাসা থেকে চা বানিয়ে এনেছি। ফ্লাস্কটাও আপনার জন্যে কিনেছি। সামান্য উপহার। দরিদ্র মানুষ।‘
আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। এটা আশা করিনি। ভদ্রলোককে কেবিনে নিয়ে বসালাম। লঞ্চ ছাড়তে দেরি আছে। কিছুক্ষণ গল্প করা যাক। ভদ্রলোক গল্পের ধার। দিয়ে গেলেন না। গাঢ় গলায় বললেন, চলে যাচ্ছেন মনটা খারাপ হয়ে গেছে। লাস্ট একটা গান শুনিয়ে দেই আপনাকে। আপনাকে গান শুনিয়ে খুব আনন্দ পেয়েছি। আপনার মত আনন্দ নিয়ে আর কেউ আমার গান শোনে না। কত ফাংশান হয়, অগা, মগা, বগা স্টেজে উঠে গান গায়। আমাকে কেউ ডাকে না। স্যার গাইব?