সন্ধ্যাবেলা হাত-মুখ ধুয়ে লিখতে বসলাম, রাতে ভাত খেতে গেলাম না। পুরোটা এক বৈঠকে বসে শেষ করতে হবে। রাত তিনটায় লেখা শেষ হল। আমি পড়তে দিলাম আমার স্ত্রী গুলতেকিনকে। সে বলল, তোমার কোন একটা সমস্যা আছে। মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। আমি লক্ষ করেছি, তুমি অনেকখানি মমতা দিয়ে একটি চরিত্র তৈরি কর, তারপর তাকে মেরে ফেল। তুমি এইসব দিনরাত্রি’তে টুনীকে মেরেছ। এবার মারলে বাকেরকে।
আমি তাকে কোন যুক্তি দিলাম না। ক্লান্ত হয়ে ঘুমুতে গেলাম। ঘুম হল না। আবার উঠে এসে বারান্দায় বসলাম। অনেকদিন পর ভোর হওয়া দেখলাম। ভোরের প্রথম আলো মনের অস্পষ্টতা কাটাতে সাহায্য করে। আমার বেলাতেও করলো। আমার মন বলল, আমি যা করেছি ঠিকই করেছি। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বাকেরকে মরতেই হবে।
যেদিন নাটক প্রচারিত হবে তার আগের দিন রাতে দৈনিক বাংলার আমার। সাংবাদিক বন্ধু হাসান হাফিজ ব্যস্ত হয়ে টেলিফোন করলেন। আমাকে বললেন, আগামীকাল প্রেসক্লাবের সামনে বাকের ভাইয়ের মুক্তির দাবীতে সমাবেশ হবে। সেখান থেকে তারা আপনার এবং বরকতউল্লাহ সাহেবের বাড়ি ঘেরাও করবে। পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। আপনি সরে যান।
নিজের ঘরে বসে সবাইকে নিয়ে আমার নাটক দেখার অভ্যাস। এই প্রথমবার নাটক প্রচারের দিন বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যেতে হল। খবর নিয়ে জানলাম, বাড়ির সামনের রাস্তায় কয়েকটা ককটেল ফাটানো হয়েছে। রাগী কিছু ছেলে ঘোরাফেরা করছে। পুলিশ চলে এসেছে। বাসায় ফিরলাম রাত একটায়। দরজার ফাঁক দিয়ে কারা যেন দুটা চিঠি রেখে গেছে। একটা চিঠিতে লেখা, বাকেরের যেভাবে মৃত্যু হল আপনার মৃত্যুও ঠিক সেইভাবেই হবে। আমরা আপনাকে ক্ষমা করলেও আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। রাত দু’টার সময় ধানমন্ডি থানার একজন সাব ইন্সপেক্টর সাহেব আমাকে জানালেন, আপনি কোন ভয় পাবেন না। আমরা আছি।
প্রচন্ড মাথার যন্ত্রণা নিয়ে রাতে ঘুমুতে গেলাম। এপাশ-ওপাশ করছি। কিছুতেই ঘুম আসছে না। আমার ছোট মেয়েটাও জেগে আছে। সেও ঘুমুতে পারছে না। তার নাকি বাকের ভাইয়ের জন্যে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় এসে বসলাম। মেয়ে কঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাবা তুমি উনাকে কেন মেরে ফেললে? আমি মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, গল্পের একজন বাকের মারা গেছে যাতে সত্যিকার বাকেররা কখনো না মারা যায়।
কথাটা হয়তো আমার ক্লাস ফোরে পড়া মেয়ের জন্যে একটু ভারী হয়ে গেল। ভারী হলেও এটাই আমার কথা। এই কথা নাটকের ভেতর দিয়ে যদি বুঝতে না পেরে থাকি তবে তা আমার ব্যর্থতা। আমি আমার সীমাবদ্ধ ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করেছি। আমার চেষ্টায় কোন খাদ ছিল না। এইটুকু আমি আপনাদের বলতে চাই। বাকেরের মৃত্যুতে আপনারা যেমন ব্যথিত আমিও ব্যথিত। আমার ব্যথা আপনাদের ব্যথার চেয়েও অনেক অনেক তীব্র। বিজ্ঞানী ডঃ ফ্রাংকেনস্টাইন নিজের তৈরি দানবটাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগে নিজেই ধ্বংস হলেন নিজের সৃষ্টির হাতে। আমি বেঁচে আছি। কিন্তু বাকের নামের একটি চরিত্রও তৈরি করেছিলাম। আজ সে নেই। মুনা আছে, সে কোনদিনই বাকেরকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে পারবে না। মুনার এই কষ্ট আমি বুকে ধারণ করে আছি। আপনারা ভুলে যাবেন। আমি তো ভুলব না। আমাকে বেঁচে থাকতে হবে মুনার কষ্ট হৃদয়ে ধারণ করে।
বটবৃক্ষ
রাত এগারোটায় গাড়িতে উঠলাম। যাব ময়মনসিংহ। ঢাকা থেকে ১২৭ কিলোমিটার পথ। তিন ঘণ্টার বেশি লাগার কথা না, কিন্তু ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। দশ হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। বুদ্ধিমানের কাজ হবে বৃষ্টি থামার জন্যে অপেক্ষা করা। সেই অপেক্ষাটুকু। করতে পারছি না। খবর এসেছে–আমার নানীজানের স্ট্রোক হয়েছে। শরীরের এক অংশ অবশ। মুখের কথা জড়িয়ে গেছে। তিনি আমাকে শেষবারের মত একবার দেখতে চাচ্ছেন। অন্য ভুবনের দিকে যাত্রার আগে আগে সবাই প্রিয়জনদের দেখতে চায়। আমি নানীজানের অতি প্রিয়দের একজন, কারণ তিনি এক অর্থে আমার দুধ-মা। আমার জন্মের পর পর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমাকে লালন করার দায়িত্ব চলে যায়। নানীজানের কাছে। সেই সময় তাঁর নিজের একটি মেয়ে হয়েছে। তিনি তাঁর ডান বুকের দুধ আমার জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বাঁ দিকেরটা তাঁর কন্যার জন্যে। বুকের দুধের কোন আকর্ষণী ক্ষমতা কি আছে? হয়ত আছে। আমি নানীজানের পাশে উপস্থিত হবার জন্য তীব্র ব্যাকুলতা অনুভব করছি।
নানীজান আমার শৈশবের একটি বড় অংশ দখল করে আছেন। চোখ বন্ধ করলেই নানার বাড়ির সব জায়গায় তাঁকে একসঙ্গে দেখতে পাই। এই দেখছি রান্নাঘরে। পিঠা তৈরি হচ্ছে, তিনি বসেছেন সরঞ্জাম নিয়ে, এই দেখছি উঠোনে, ধান শুকানো হচ্ছে, তিনি এক ফাঁকে এসে কাক তাড়িয়ে গেলেন। এই দেখছি পুকুর ঘাটে। বাচ্চারা সবাই পানিতে নামবে–তিনি তাদের একা ছেড়ে দিতে ভরসা পাচ্ছেন না, সঙ্গে আছেন।
রাতগুলি তো অপূর্ব! তিনিই তখন সম্রাজ্ঞী। গল্পের আসর বসেছে। তিনি একের পর এক ভূতের গল্প বলে যাচ্ছেন। রক্ত জমাট করা ভয়ংকর কিছু গল্প আমি নানীজানের কাছে শুনেছি। তাঁর বর্ণনাভঙ্গি খুব সাধারণ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভূতের গল্পগুলি এমনভাবে বলেন যে এসব কিছুই না, সব সময় ঘটছে। পান খেতে খেতে একটু নিচু গলায় গল্প শুরু করবেন। ঘটনাটা কোথায় ঘটল সেই বিষয়ে আগে অনেকক্ষণ ধরে বলেন। তারপর হঠাৎ মূল গল্পে চলে যান–