সে বলল, তিনশ’ টাকা স্যার।
আমি বিস্মিত। মাত্র তিনশ’ টাকা ক্যাপিটেলে ব্যবসা? মানিব্যাগ খুলে তিনশ’র বদলে তাকে পাঁচশ টাকা দিয়ে দিলাম। সে খুশি হয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বিদেয় হল। তখন আমার মনে হল–তিনশ’ দিলেই তো হত। দুশ টাকা বাড়তি কেন দিলাম? মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল।
কেন আমাদের মধ্যে এই ক্ষুদ্রতা? আমরা কি এই ক্ষুদ্রতার উর্ধ্বে উঠতে পারি না? কেন পারি না?
এক দুপুরের কথা। দরজার কড়া নড়ছে। দরজা খুলে দেখি তিনজন ভিখিরি শিশু। সবচে’ বড়টির বয়স সাত-আটের বেশি না। তার কোলে দু’বছর বয়সী একজন। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে তিনজনের মুখই আনন্দে উদ্ভাসিত। তারা জানালো, ভাত লাগবে না। তাদের প্রচুর ভাত আছে। শুধু তরকারি হলেই তারা এখানে বসে খেয়ে নেবে। তরকারি না হলেও অসুবিধা নেই–ডাল দিলেই হবে। তাদের তরকারি দেয়া হল। ইতিমধ্যে আমাদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে। ওদের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল এখনো তাদের খাওয়া হয়নি। ডাল এবং তরকারি নিয়ে বসে আছে। সমস্যাটা কি?
সমস্যা হল ভাত নিয়ে। এদের ভাত আছে ঠিকই–কিন্তু তারা খেতে পারছে না, কারণ ভাত বরফের মত শক্ত হয়ে আছে। এক দলা ভাত, ডীপ ফ্রীজে রাখায় জমে পাথর হয়ে আছে। দু-তিন ঘণ্টার আগে এই ভাত মুখে দেয়া যাবে না। বাচ্চারা বরফের দলায় কামড় বসানোর চেষ্টা করেছে–লাভ হয়নি। দাঁত বসানো যাচ্ছে না।
আমাদের বাসায় দেবার মত ভাত নেই। দিতে হলে নতুন করে ভাত চড়াতে হবে। আমি তাই করতে বললাম। হোক গরম ভাত, রান্না হোক–এরা এক বেলা অন্তত। আরাম করে খাক। ভাত রান্না করে দেয়া হল। কিন্তু এর মধ্যে এরা ডাল এবং তরকারি চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছে। তাতে এদের অসুবিধা হল না–গরম ভাতই শুধু শুধু মুখ ভর্তি করে খাচ্ছে। দু’বছরের শিশুটিও মহানন্দে ভাত চিবুচ্ছে। এ কোন অদ্ভুত পৃথিবী!
আমরা বিশ্বাস করি–পৃথিবীর সব মানুষ একই বাব-মাসন্তান। আমাদের আদি পিতা হযরত আদম, আদি মাতা বিবি হাওয়া। একই বাবা-মা’র সন্তান হয়েও আজ আমরা এমনভাবে আলাদা হয়ে পড়লাম কি করে? একদলের কাপড় প্যারিস থেকে ধুইয়ে আনতে হয়, আরেকদলের কোন কাপড়ই নেই।
কাপড় প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বলি–আমার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান নুহাশ-এর জন্ম হয়। শীতকালে। মাঘ মাসের দুর্দান্ত শীত। শীতের বিরুদ্ধে সব ব্যবস্থা নেয়া হল। দুটি রুম হিটার। নরম লেপ, মাথায় কান-ঢাকা টুপি, হাতে-পায়ে নরম উলের মোজা। সাধ্য কি শীত তাকে স্পর্শ করে? তবু সারাক্ষণ ভয়–এই বুঝি ঠাণ্ডা লেগে গেল। এই বুঝি বুকে কফ বসে গেল। আরো গরম কাপড় দরকার। খবর পাওয়া গেল, গুলশান মার্কেটে স্লীপিং ব্যাগ জাতীয় এক ধরনের কম্বল পাওয়া যায়। বাচ্চাকে ভেতরে ঢুকিয়ে বোতাম লাগিয়ে দিলে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত।
গেলাম ব্যাগ কিনতে। ফেরার পথে দেখি ঠিক আমার ছেলের বয়েসী একটি ছেলেকে তার মা মেঝেতে শুইয়ে রেখেছে। বাচ্চাটা আছে চটের বস্তার ভেতর। বস্তায় একটা ফুটো করা হয়েছে। ফুটোর ভেতর দিয়ে বাচ্চাটার ফর্সা মুখ বের হয়ে আছে–সে চোখ বড় বড় করে দেখছে চারপাশের অকরুণ পৃথিবী।
আমার প্রচণ্ড ইচ্ছা হল–নতুন কেনা স্লীপিং ব্যাগ জাতীয় কম্বলটি এই বাচ্চাটিকে দিয়ে দেই। তারই এটি বেশি দরকার। মা তার বাচ্চাটিকে এর ভেতর ভরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারবে। তারা থাকবে খোলা বারান্দায়–শীতের প্রচণ্ড হাওয়া এই ব্যাগ ভেদ করে বাচ্চাটির গায়ে পৌঁছতে পারবে না।
আমি নিজেকে সামলে নিলাম। নিজেকে বুঝালাম, এদের এই জিনিস দিয়ে কোন লাভ হবে না। ভিখিরী-মা সঙ্গে সঙ্গে অন্যের কাছে এটা বিক্রি করে দেবে। তাছাড়া বাচ্চাটির শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় হওয়া দরকার–কারণ তার জন্যে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
নিতান্তই বাজে যুক্তি। নিজের অপরাধবোধ ঢাকার জন্যে তৈরি করা মিথ্যা যুক্তি। তারপরেও মনটা খারাপ হয়ে রইল। গরম কাপড়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢাকা আমার বাচ্চাটির দিকে তাকালেই মনে হত, আরেকটি শিশু আছে যে দেখতে ঠিক তার মত, হয়ত জন্মও হয়েছে একই দিনে–সে খালি গায়ে বাস করছে। তার হতদরিদ্র মা তার শরীরের সবটুক উত্তাপ বাচ্চাটিকে দিতে চেষ্টা করছে। আজকের অতি আধুনিক, সুসভ্য পৃথিবীতে ঐ শিশুটির সম্বল শুধু মা’র বুকের সামান্য উত্তাপ।
পরীক্ষা
একটা নির্দিষ্ট বয়সের বাবা-মা’রা মনে করতে শুরু করেন তাদের ছেলেমেয়েরা বোধহয় তাদের আর ভালবাসে না, বোধহয় তারা এখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নিজেদের সংসার। নিয়ে নিজেদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে। তবে এই ব্যাপারে তারা পুরোপুরি নিশ্চিতও হতে পারেন না। এক ধরনের সন্দেহ থাকে–হয়ত এখনো ভালবাসে। হয়ত বাবা মা’র প্রতি ভালবাসা নিঃশেষ হয়নি। এই সংশয়-জড়ানো দোদুল্যমান সময়ে বাবা-মা’রা নানান ধরনের ছোটখাট পরীক্ষা করতে থাকেন। ছেলেমেয়েদের ভালবাসা এখনো। আছে কি-না তা নিয়ে পরীক্ষা। পরীক্ষার ফলাফল নিয়েও তারা সংশয়ে ভুগেন। কোন ফলাফলই তাদের ১০০ ভাগ নিশ্চিত করতে পারে না।
আমার মা বর্তমানে এ জাতীয় মানসিক অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তার ছ’টি ছেলেমেয়েকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছেন। তাদের আচার-আচরণ থেকে ধরার চেষ্টা করছেন–ছেলেমেয়েদের মধ্যে তার প্রতি ভালবাসা কতটুকু অবশিষ্ট আছে।