আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত লোকটির খাওয়া দেখলাম। খাওয়া শেষে গভীর তৃপ্তিতে তার পানি খাওয়া দেখলাম। পান মুখে পুরতে দেখলাম। পান মুখে দেয়া মানুষটিকে মনে হল এই পৃথিবীর সুখী মানুষদের একজন। আমার কাছে মনে হতে লাগল, আহা, এই মানুষটা যদি ইলিশ মাছের টাটকা ঝোল দিয়ে গরম গরম ভাত খেতে পারত তাহলে কি গভীর আনন্দেই না সে খেত! এই ঘটনা আমি অনেককে বলেছি, তাদের কেউই বুঝতে পারেনি অভিভূত হবার মত এর মধ্যে কি আছে? আমার এক বন্ধু বললেন–এটা। হচ্ছে এক ধরনের দুঃখবিলাস।, দরিদ্র মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে উচ্চবিত্তের মিথ্যা দুঃখ। শখের দুঃখ।
আমি বললাম, মিথ্যা হবে কেন?
সে বলল, মিথ্যা, কারণ তুমি যদি এতই অভিভূত, তাহলে তুমি তাকে বলতে পারতে–ভাই, আপনি আসুন তো, ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাবেন। আমি পয়সা দেব। তুমি তা বলনি। তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছ। অন্যের দুঃখ নিয়ে বিলাস করেছ।
বন্ধুর সঙ্গে আমি তর্কে যাইনি। যেতে পারতাম। ফট করে একজনকে বলা যায় না–আপনি ভাত খান, আমি পয়সা দেব। এই কাজটি তখন করা যায় যখন কেউ খেতে চায়। তাছাড়া ঐ মানুষটি নিজের অর্থে কেনা সামান্য খাবার অতি আগ্রহ করে খাচ্ছে–সেখানে আমি উপদ্রবের মত উপস্থিত হয়ে তার খাওয়া নষ্ট করতে পারি না। আমার প্রস্তাবে লোকটি বলে বসতে পারত–আপনি আমাকে খাওয়াবেন কেন? আপনি। কে? আমি কি আপনার কাছে ভিক্ষা চেয়েছি?
কেউ হয়ত আমার সঙ্গে একমত হবেন না, কিন্তু তবু আমার সব সময় মনে হয় দয়া দেখানোর মধ্যেও এক ধরনের দীনতা আছে। আমি দয়া দেখাচ্ছি, কারণ আমার অনেক আছে। ‘আমার অনেক আছে’–চিন্তাটাই তো এক ধরনের দীনতা।
আমার ছোটভাই গত বছর আমেরিকা থেকে আমার মা’র নামে এক হাজার ডলার পাঠিয়ে দিল। ডলারের সঙ্গে একটা ছোট্ট চিঠি।
আম্মা, আপনাকে এক হাজার ডলার পাঠালাম। একটা বিশেষ উদ্দেশে ডলার পাঠানো হয়েছে। আমি অনেকদিন দেশের বাইরে আছি। এখানে দান-খয়রাতের তেমন সুযোগ নেই। কেন জানি কিছু দান করতে ইচ্ছা করছে–আপনি ডলার ভাঙিয়ে যে টাকা পাবেন তা দরিদ্র মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দেবেন। তবে আমাদের দরিদ্র আত্মীয়স্বজনদের এই টাকাটা দেবেন না। আমি টাকা পাঠিয়েছি যারা সত্যিকার অর্থেই ভিক্ষুক–তাদের জন্যে।
মা ডলার ভাঙিয়ে প্রায় আটত্রিশ হাজার টাকার মত পেলেন। অনেক টাকা। ফকিরকে ভিক্ষা দেয়ার জন্যে তো প্রচুরই বলা চলে। এক সপ্তাহ ধরে মা সেই টাকা বিলি করলেন। মা’কে সাহায্য করল আমার সবচে’ ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। দু’জনকেই দেখলাম ব্যাপারটায় প্রচুর আনন্দ পাচ্ছে। ফকির ভিক্ষা চাইতে আসে। তার চেহারা, কাপড়-চোপড় দেখে বিবেচনা করা হয় কি পরিমাণ সাহায্য তাকে দেয়া যায়। কেউ পায় ৫০ টাকা, কেউ একশ’। দু’-একজন মহাসৌভাগ্যবান পায় ৫০০ টাকা। এসব ক্ষেত্রে যা হয়–দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ে–এবং হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে। মহা বিশৃঙ্খলা, মহা ভিড়ে–কেউ কেউ মারাও যায়। আমিও আশংকা করেছিলাম এরকম কিছু হবে। কেন জানি হল না। মা এক জায়গা থেকে টাকা না দিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিলেন বলেই খবরটা তেমন জানাজানি হল না।
টাকা বিলি শেষ হবার পর একদিন মা’র কাছে গিয়েছি। তিনি খুব উৎসাহ নিয়ে গল্প করছেন–টাকা পাবার পর একেক জনের কি অবস্থা হল। আমার তখন মনে। হল–এই দানে যে আনন্দ আমার মা পেলেন তা অন্যকে সাহায্য করার আনন্দ নয়। ক্ষমতার আনন্দ, এই আনন্দের সঙ্গে কিছুটা হলেও দীনতা মিশে আছে।
অন্যের দুঃখে অভিভূত হয়ে যে দান করা হয় তাতে দীনতার গ্লানি থাকে না। সেই আনন্দের ভাগ আমাদের ভাগ্যে জুটে না বললেই হয়। আমি দেখেছি, অন্যের দুঃখে অভিভূত হয়ে যে দান করা হয় তার বড় অংশই করা হয় সাময়িক ঝোঁকের মাথায়। ঝোঁক কেটে গেলে মনে হয়–এটা কি করলাম?
উদাহরণ দেই–আমার এক দূর সম্পর্কের মামার গল্প। তিনি একবার গুলিস্তান থেকে রিকশা করে ফিরছেন–প্রচণ্ড শীতের রাত। হঠাৎ লক্ষ করলেন, ফুটপাতে এক ভিখিরি-পরিবার ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে শুয়ে আছে। তাদের সম্বল একটামাত্র কাঁথা। কাঁথায় সবার হচ্ছে না। তারা টানাটানি করছে। মামার মন খুব খারাপ হল। বাসায় পৌঁছে কাউকে কিছু না বলে তাঁর নিজের লেপ নিয়ে রওনা হলেন। মামী বললেন, কি করছ তুমি? লেপ নিয়ে কোথায় যাচ্ছ? তিনি বললেন, চুপ করে থাক। কথা বলবে না। তিনি ওদের লেপ দিয়ে এসে বাসায় ফিরলেন। ততক্ষণে তাঁর ঝোঁক কেটে গেছে। তিনি হায় হায় করছেন–ছয়শ’ টাকা খরচ করে নতুন লেপ বানানো হয়েছে–লেপটা দেয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। ত্রিশ টাকা দিয়ে একটা পুরানো কম্বল কিনে দিলেই যথেষ্ট হত।
এ জাতীয় ঘটনা আমার নিজের বেলাতেও ঘটেছে। তখন শহীদুল্লাহ হলে থাকি। সন্ধ্যাবেলায় একজন অন্ধ ছেলে এসে উপস্থিত। আমার কাছে সে নালিশ করতে। এসেছে। নালিশ করতে এসেছে অন্ধ কল্যাণ সমিতির বিরুদ্ধে। সে বল পয়েন্টের ব্যবসা করে। বল পয়েন্ট কিনে ছাত্রদের কাছে বিক্রি করে। অন্ধ কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি তাঁকে বলেছিলেন–ব্যবসার জন্যে টাকা দেবেন। এখন দিচ্ছেন না। আমি যদি সেক্রেটারিকে কিছু বলে দেই তাহলে সে টাকাটা পায়। কারণ সেক্রেটারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অন্ধ ছাত্র। আমি দেখলাম–বিরাট যন্ত্রণা। সেক্রেটারীকে কিভাবে পাব? তাকে বলবই বা কি? অন্ধ ছেলেটির জন্যেও মায়া লাগছে। বেচারা কাঁদতে শুরু করেছে। আমি বললাম, ব্যবসা করতে ক্যাপিটেল কত লাগে?