অধ্যাপক গ্লাসের কথা কতটুকু সত্যি আমি জানি না। সে যেভাবে ব্যাপারটাকে দেখেছে অন্যরাও সেভাবে দেখেছে কিনা তাও জানি না। গ্লাসের কথা আমার ভালোই লাগলো। আমি হাসিমুখে বললাম, তুমি আমাকে তোমার মতো করেই ডাকো।
বিদায় নিয়ে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে গ্লাস বললো, হামান, ভালো থেকো এবং আগলি আমেরিকানদের কথা মনে রেখো।
শেষ পর্বে শঙ্খনদী
পচাগড় থেকে বাবা বদলি হলেন রাঙ্গামাটিতে।
দেশের এক মাথা থেকে আরেক মাথা। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ। ভাগ্য ভালো হলে দেখা যাবে রাঙ্গামাটি খুব জলি জায়গা– স্কুল নেই। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, স্কুল আছে নাকি?
তিনি বললেন, অবশ্যই আছে। স্কুল থাকবে না কেন? রাঙ্গামাটি বেশ বড় শহর। খুব সুন্দর শহর!
স্কুল আছে শুনে একটু মনমরা হয়ে গেলাম। নিরবচ্ছিন্ন সুখ বলে কিছুই নেই। কাবাবে হাড্ডি থাকে, চাঁদে থাকে কলঙ্ক। স্কুলের যন্ত্রণা সহ্য করতেই হবে বলে মনে হচ্ছে।
চিটাগাং থেকে রাঙ্গামাটি যেতে হয় লক্কর-মার্কা বাসে। রাস্তা অসম্ভব খারাপ। পাহাড়ের গা-ঘেঁষে বাস যখন উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন বাসে, হেল্পার চেঁচিয়ে বলে, আল্লাহর নাম নেন। ইসটার্ট বন্ধ হইতে পারে।
সত্যি সত্যি স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। ভবিষ্যদ্বাণী এমন ফলে গেছে দেখে কন্ডাকটারের মুখে বিমলানন্দের হাসি। ড্রাইভার বাস থেকে বের হয়ে নিশ্চিন্ত মনে বিড়ি খাচ্ছে। তার নির্বিকার ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রায়ই ঘটে।
বাস কখন ছাড়বে জিজ্ঞেস করতেই সে সুফি-সাধকের মতো নির্লিপ্ত গলায় বলল, আল্লাহর হুকুম হইলেই ছাড়ব। আমরা বাসযাত্রীরা বাস থেকে নেমে আল্লাহর হুকুমের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
মা আমাদের সর্বকনিষ্ঠ বোনটির কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দীর্ঘ ভ্রমণে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ক্রমাগত কাঁদছে। বাবা আমাদের নিয়ে বের হয়েছেন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে এগুচ্ছি-এ কোথায় এসে পড়লাম। স্বপ্নপুরীর মতো সুন্দর দেশ! চারদিকে পাহাড়ের সারি ঢেউয়ের মতো দিগন্তে মিলিয়ে গেছে। মাথার উপর ঘন নীল আকাশ বাতাসে কেমন যেন বুনো বুনো গন্ধ। রাস্তার পাশ ঘেঁষে ঝরনা বয়ে যাচ্ছে। কী পরিষ্কার তার পানি! বাসযাত্রীরা আঁজলা ভরে সেই পানি খাচ্ছে।
কিছুদূর এগুতেই যে-দৃশ্য দেখলাম তা দেখার জন্যে মানসিক প্রস্তুতি ছিল। হাতির খেদা থেকে ধরে-আনা একপাল হাতি। প্রতিটি হাতির পা দড়ি এবং শিকল দিয়ে বাঁধা। রুগ্ণ ভয়ার্ত চেহারা। সব মিলিয়ে সাত থেকে আটটা হাতি। দুটি হাতির বাচ্চাও আছে। এরা বাধা নয়, ছোটাছুটি করছে। দেখতে অবিকল পুতুলের মতো। বাচ্চা দুটি দেখে মনে হল তারা সময়টা কাটাচ্ছে খুব আনন্দে।।
খেদার মালিক এগিয়ে এলেন। বাবাকে বললেন-সর্বমোট একুশটা হাতি ধরা পড়েছে। দশটা বিক্রি হয়েছে, তিনটা মারা গেছে। এখানে যে-ক’টা আছে। সে-ক’টাও মারা যাবে। কোনো হাতি কিছু খাচ্ছে না। খেদার মালিক বলল, হাতির বাচ্চা একটা নেবেন নাকি স্যার?
বাবা কিছু বলবার আগেই আমরা চেঁচিয়ে উঠলাম, নেব নেব।
বাবার মুখ দেখে মনে হল প্রস্তাবটা তিনি একেবারে ফেলে দিচ্ছেন না। বিবেচনাধীন আছে। তিনি নিচু গলায় বললেন, দাম কত?
দাম নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। বলতে গেলে বিনা দামে বিক্রি হবে। আপনি চান কি না বলেন। নিলে আমার উপকার হয়। বাচ্চা দুটা এখন সমস্যা। ডিসি সাহেব একটা নিবেন বলেছিলেন, এখন বলছেন–না।
হাতির বাচ্চা শেষ পর্যন্ত কেনা হল না। কারণ এরা এখনও দুগ্ধপোষ্য। প্রতিদিন আধমণ দুধ এদের খাওয়াতে হবে। আমরা মন খারাপ করে বাসে ফিরে এলাম। বাবা বললেন, পাহাড়ি জায়গায় আছি–হাতির বাচ্চা জোগাড় করা কোনো সমস্যা হবে না। একটা হাতির বাচ্চা কেনা যেতে পারে। আগে একটু গুছিয়ে বসি। তোমাদের মন খারাপ করার কোনো কারণ নাই! এই বলে তিনি নিজেই সবচে’ বেশি মন-খারাপ করলেন। বাসা ঠিকঠাক হতে অনেক সময় লাগল। আমরা রাঙ্গামাটি পৌঁছলাম দুপুর-রাতে। আমাদের বাসা মূল শহর থেকে অনেকখানি দূরে। একটা পাহাড়ের মাথা কেটে ছ’টা বাড়ি বানানো হয়েছে। ঐ ছ’টা বাড়ির একটা আমাদের। অতি নির্জন জায়গা। চারদিকে ঘন বন। অদ্ভুত সব আওয়াজ আসছে বন থেকে। মা ভীতগলায় বললেন, এ কোথায় এনে ফেললে? বাবার মুখও শুকিয়ে গেল। এরকম বিরানভূমিতে বাসা, তা বোধহয় তিনিও ভাবেননি।
বাসা আমাদের খুব পছন্দ হল। পাহাড়ের উপর বাসায় আমরা থাকব এরকম তো কখনো ভাবিনি। এরকম বাসায় থাকা মানে আকাশের কাছাকাছি থাকা। কী সৌভাগ্য আমাদের! তারপর যখন শুনলাম আশেপাশে কোনো স্কুল নেই, আমাদের স্কুলে যেতে হবে না, তখন মনে হল আনন্দে পাগল হয়ে যাব।
সারাদিন খেলা। নতুন একটা খেলা বের করেছি। পাখি-পাখি খেলা। দুহাত পাখির ডানার মতো উঁচু করে এক দৌড়ে পাহাড় থেকে নিচে নামা। একসময় আপনা-আপনি গতি বাড়তে থাকে-মনে হয় সত্যি উড়ে চলেছি–পাখি হয়ে গেছি।
সন্ধ্যার পর বই নিয়ে বসি। সেটাও একধরনের খেলা। পড়া-পড়া খেলা। কারণ পড়া দেখিয়ে দেবার কেউ নেই। শাসন করার কেউ নেই।
বাবা প্রায় সারা মাস টুরে থাকেন। মা সবচে ছোট বোনটিকে নিয়ে ব্যস্ত। বড় মামাও সঙ্গে নেই। এই প্রথম উনি ঠিক করেছেন আমাদের সঙ্গে আসবেন না। বড় বোনের পরিবারের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে জীবন নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। নিজের পায়ে দাঁড়াবেন।