মামার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। হুংকার দিয়ে বললেন-মমা? মামা মানে? চড় দিয়ে সব দাঁত খুলে ফেলব। স্কুলে আমি তোমাকে চিনি না। তুমিও আমাকে চেন না। বলো, ৬-এর ঘরের নামতা বলো। পাঁচ ছয় কত?
আমি হতভম্ব।
একি বিপদ! ছয়ের ঘরের নামতা যে জানি না এটা বড়মামা খুব ভালো করেই জানেন। কারণ তিনি আমাদের পড়ান।
তিনি দুনিয়া-কাঁপানো হুংকার দিলেন, কী, পারবে না?
আবার কী? বলো, জি না।
জি না।
বলো, জি না স্যার।
জি না স্যার।
না পারার জন্যে শাস্তির ব্যবস্থা হবে। আত্মীয় বলে আমার কাছ থেকে পার পাওয়া যাবে না। আমার চোখে সব সমান। সবাই ছাত্র। ক্লাস-ক্যাপ্টেন কোথায়? যাও, বেত নিয়ে আসো।
বেত আনা হল। এবং সত্যি সত্যি বড়মামা ছয়টি বেতের বাড়ি দিলেন–যেহেতু ছয়ের ঘরের নামতা।
স্কুলে মোটামুটি আতঙ্কের সৃষ্টি হয়ে গেল। ছাত্রমহলে রটে গেল ভয়ংকর রারী একজন স্যার এসেছেন। অতি কড়া, তার ক্লাসে নিশ্বাস ফেলা যায় না
বড়মামার চাকরি দীর্ঘস্থায়ী হল না। স্থানীয় এস.ডি.ও. সাহেবের ছোট ভাইকে কানে ধরে উঠবস করার কারণে তার চাকরি চলে গেল। আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বড়মামা আবার আগের মূর্তিতে ফিরে এসেছেন। গল্প করছেন, আমাদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোথায় গেলে নাকি রাতের বেলা দার্জিলিং শহরের বাতি দেখা যায়, নিয়ে গেলেন।
গভীর রাত পর্যন্ত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছি। দার্জিলিং শহরের বাতি আর দেখছি না। উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড় ব্যথা হয়ে গেল। কিছুই দেখা গেল না। বড়মামা বিরক্ত হয়ে বললেন, ওদের আজ বোধহয় ইলেকট্রিসিটি ফেল করেছে। আরেকদিন আসতে হবে। অসাধারণ দৃশ্য! না দেখলে জীবন বৃথা।
একদিন সাইকেলের সামনে বসিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন পাহাড়ি নদী দেখাতে। প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা সাইকেল চালিয়ে নালার মতো একটা জলধারা পাওয়া গেল। মামা বললেন, তুমি ঘুরে বেড়াও। আমি এই ফাঁকে একটা কবিতা লিখে ফেলি। মামা নদীর পাড়ে বসে কুলটানা খাতায় কবিতা লিখতে বসলেন। দীর্ঘ কবিতা লেখা হল। কবিতার নামটা মনে আছে।
হে পাহাড়ী নদী।
বড়মামার এই কবিতা স্থানীয় একটি পত্রিকায় ছাপাও হল। পচাগড়ের দিনগুলি আমাদের কাছে একসময় সহনীয় হয়ে উঠল এবং ভালো লাগতে লাগল। আমার একজন বন্ধু জুটে গেল যে নর্দমার পানিতে মাছ মারার ব্যাপারে একজন বিশেষজ্ঞ। দুজনেই বড়শি-হাতে নর্দমায় নর্দমায় ঘুরে বেড়াই। নর্দমায় ট্যাংরা, লাটি এবং পুঁটিমাছ পাওয়া যায়। আমার বন্ধুর পকেটে নারিকেলের মালায় থাকে কেঁচো। সে পকেটে হাত ঢুকিয়ে এক টুকরা কেঁচো নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বড়শিতে গেঁথে পানিতে ফেলে দেয়। দেখতে বড় ভালো লাগে।
নামে কিবা আসে যায়
‘সামার হলিডে’ শুরু হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত সবার মনই এই সময় খানিকটা তরল অবস্থায় থাকে। অত্যন্ত কঠিন অধ্যাপককেও এই সময় নরম এবং আদূরে গলায় কথা বলতে দেখা যায়।
আমার অধ্যাপকের নাম জোসেফ এডওয়ার্ড গ্লালাস নামের সার্থকতা বুঝানোর জন্যই হয়তো ভুদ্রলোক কাচের মতো কঠিন এবং ধারালো। সামার হলিডের তারল্য তাকে স্পর্শ করেনি। ভোর ন’টায় ল্যাবে এসে দেখি সে একটা বিকারের কপার সালফেটে সলুসন বানিয়ে খুব ঝাঁকাচ্ছে। নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছে, ভোরবেলা গ্লাসের সঙ্গে দেখা হলে সারাটা দিন খারাপ যাবে।
গ্লাসকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। প্রবাদের কারণে নয়। মন খরাপ হলো কারণ ব্যাটার আজ থেকে ছুটিতে যাবার কথা। যায়নি যখন তখন বুঝতে হবে সে এই সামারে ছুটিতে যাবে না। ছুটির তিন মাস আমাকে জ্বালাবে। কারণ জ্বালানোর জন্যে দ্বিতীয় ব্যক্তি ল্যাবে নেই। সবাই ছুটি নিয়ে কেটে পড়েছে।
আমি প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রাণ গলায় বললাম,-হাই।
গ্লাস আনন্দে সব কটা দাঁত বের করে বলল, তুমি আছো তাহলে। থ্যাংকস। এসো দু’জনে মিলে এই সশানটার ডিফারেনসিয়েল রিফ্লেকটিভ ইনবক্স বের করে ফেলি।
আমি বললাম, এটা সম্ভব না। আমি আমার নিজের কাজ করবো। এর মধ্যে তুমি আমাকে বিরক্ত না করলে খুশি হবো।
বাংলাদেশের পাঠক-পাঠিকারা আমার জবাব শুনে হয়তো আঁতকে উঠেছেন। আমার পি-এইচ-ডি গাইড এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রায় ঈশ্বরের মতো ক্ষমতাবান একজন অধ্যাপকের সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলা যায় কিনা তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে না, তবে আমেরিকান চরিত্র সম্পর্কে যাদের কিছুটা ধারণা আছে, তারাই বুঝবেন আমার জবাব হচ্ছে যথাযথ জবাব।
প্রফেসর গ্লাস খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বলল, হামাদ, এটা সামান্য কাজ। এক ঘণ্টাও লাগবে না।
আমি বললাম, আমাকে হামাদ ডাকছ কেন? আমার নাম হুমায়ুন আহমেদ। হামাদটা তুমি পেলে কোথায়?
নাম নিয়ে তুমি এত যন্ত্রণা করো কেন হামাদ? নামে কি যায় আসে? আমি একজন ওল্ডম্যান। তোমাকে রিকোয়েস্ট করছি কাজটা করে নিতে। আর তুমি নাম নিয়ে যন্ত্রণা শুরু করে দিলে।
আমি ডিফারেনসিয়েল রিফ্লেকাটিভ ইনডেক্স বের করে দিলাম। ঝাড়া পাঁচ ঘণ্টা লাগলো। কোনো কিছুই হাতের কাছে নেই। সবাই ছুটিতে। নিজেকে ছুটাছুটি করে প্রত্যেকটি জিনিস জোগাড় করতে হয়েছে।
প্রফেসর গ্লাস আমার পাশেই চুরুট হাতে বসে খুব সম্ভব আমাকে খুশি রাখবার জন্যই একের পর এক রসিকতা করছে। রসিকতাগুলোর সাধারণ নাম হচ্ছে ডার্টি জোকস। ভয়াবহ ধরনের অশ্লীল।