প্রতিদিন ভোরে তিন ভাইবোন রাজবাড়ির মন্দিরের চাতালে বসে রোদ গায়ে মাখি। এই সময় আমাদের সঙ্গ দেয় বেঙ্গল টাইগার। বেঙ্গল টাইগার হচ্ছে আমাদের কুকুরের নাম। না, আমাদের কুকুর নয়, মহারাজার কুকুর। তার নাকি অনেকগুলি কুকুর ছিল। তিনি সবকটাকে নিয়ে যান, কিন্তু এই কুকুরটিকে নিতে পারেননি। সে কিছুতেই রাজবাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি।
মা তাকে দুবেলা খাবার দেন। মাটিতে খাবার ঢেলে দিলে সে খায় না। থালায় করে দিতে হয়। শুধু তাই না, খাবার দেবার পর তাকে মুখে বলতে হয়–খাও।
খানদানি কুকুর। আদব-কায়দা খুব ভালো। তবে বয়সের ভারে সে কাবু। সারাদিন বাড়ির সামনে শুয়ে থাকে। হাই তোলে, ঝিমুতে ঝিমুতে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে।
এক ভোরবেলার কথা। আমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। আমি কম্বল গায়ে দিয়ে মন্দিরের চাতালে বসে আছি। আমার সঙ্গে শেফু এবং ইকবাল। মা এসে আমাদের মাঝখানে শাহীনকে আমার ছোট ভাই বসিয়ে দিয়ে গেলেন। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তার দিকে নজর রাখা, সে যেন হামাগুড়ি দিয়ে চাতাল থেকে পড়ে না যায়।
মা চলে যাবার পরপরই হিসহিস শব্দে পেছনে ফিরে তাকালাম। যে-দৃশ্য দেখলাম সে-দৃশ্য দেখার জন্য মানসিক প্রস্তুতি আমার ছিল না। মন্দিরের বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে প্রকাণ্ড একট কেউটে সাপ বের হয়ে আসছে। মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসে। ফণা তুলে এদিক-ওদিক দেখছে, আবার মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসছে, আবার ফণা তোলে। আমরা তিন ভাইবোন ছিটকে সরে গেলাম। শাহীন একা বসে রইল, সাপ দেখে তার আনন্দের সীমা নেই। সে চেষ্টা করছে সাপটির দিকে এগিয়ে যেতে। আর তখনই বেঙ্গল টাইগার ঝাঁপিয়ে পড়ল সাপটির উপর। ঘটনা এত দ্রুত ঘটল যে আমরা কয়েক মুহূর্ত বুঝতেই পারলাম না কী হচ্ছে। একসময় শুধু দেখলাম কুকুরটা সাপের ফণা কামড়ে ছিঁড়ে ফেলেছে। বেঙ্গল টাইগার ফিরে যাচ্ছে নিজের জায়গার। যেন কিছুই হয়নি। নিজের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড সে শেষ করল।
সাপ কুকুরটিকে কামড়াবার সুযোগ পেয়েছিল কি না জানি না। সম্ভবত কামড়ায়নি। কারণ কুকুরটি বেঁচে রইল, তবে নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিল।
দ্বিতীয় দিনে তার চামড়া খসে পড়ল এর দগদগে ঘা দেখা দিল। এই থেকে মনে হয় সাপ সম্ভবত কামড়েছে। সাপের বিষ কুকুরের ক্ষেত্রে হয়তো তেমন ভয়াবহ নয়।
আরও দুদিন কাটল। কুকুরটি চোখের সামনে পচেগলে যা।চ্ছে। তার কাতরধ্বনি সহ্য করা মুশকিল। গা থেকে গলিত মাংসের দুর্গন্ধ আসছে।
বাবা মাকে ডেকে বললেন, আমি এর কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। তুমি বন্দুক বের করে আমাকে দাও।।
বাবা আমাদের চোখের সামনে পরপর দুটি গুলি করে কুকুরটিকে মারলেন। শান্ত গলায় বললেন, যে আমার কাজলের জীবন রক্ষা করেছে তাকে আমি গুলি করে মারলাম। একে বলে নিয়তি
আমার কাছে বাবাকে পৃথিবীর নিরতম মানুষদের একজন বলে মনে হল। নিজেকে কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না এমন একটি কাজ তিনি কী করে করতে পারলেন। রাগে দুঃখে ও অভিমানে রাতে ভাত না খেয়ে শুয়ে পড়েছি। বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে বারান্দায় বসালেন।
দুজন চুপচাপ বসে আছি। চারদিকে ঘন অন্ধকার। তক্ষক ডাকছে। বাড়ির চারপাশের আমের বনে হাওয়া লেগে বিচিত্র শব্দ উঠছে।
বাবা কিছুই বললেন না। হয়তো অনেক কিছুই তার মনে ছিল। মনের ভাব প্রকাশ করতে পারলেন না। একসময় বললেন, যাও ঘুমিয়ে পড়ো।
কুকুরটি আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল।
আমার মনে আছে–এই নিয়ে আমি কিছু-একটা লিখতে চেষ্টাও করেছিলাম। রচনাটির নাম দিয়েছিলাম বেঙ্গল টাইগার কিংবা আমাদের বেঙ্গল টাইগার। সম্ভবত এই রচনাই আমার প্রথম সাহিত্য। বলাই বাহুল্য, অতি তুচ্ছ রচনা। কিন্তু হৃদয়ের গভীর যাতনায় যার জন্ম তাকে তুচ্ছই-বা করি কী করে?
জগদলে বেশিদিন থাকা হল না। বাবা বদলি হলেন দিনাপুরের পচাগড়ে [পঞ্চগড়]। এই জায়গা সম্পর্কে আমার বিশেষ কিছু মনে নেই, শুধু মনে আছে ভোরবেলা বাসার সামনে এসে দাঁড়ালে কাঞ্চনজঙ্ঘার ধবল চুড়া দেখা যেত। মনে হত পাহাড়টা রূপার পাতে মোড়া। সূর্যের আলো পড়ে সেই রূপা চকচক করছে। বাবা আমাদের মধ্যে সাহিত্যবোধ জাগ্রত করবার জন্যেই হয়তো এক ভোরবেলায় ঘোষণা করলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে নিয়ে যে একটা কবিতা লিখতে পারবে সে চার আনা পয়সা পাবে। অনেক চেষ্টা করেও কোনো কবিতা দাঁড় করাতে পারলাম না। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। আরও মন-খারাপ হল যখন আমাদের তিন ভাইবোনকে স্কুলে ভরতি করিয়ে দেয়া হল।
স্কুলে ভরতি করতে নিয়ে গেলেন বড়মামা। তিনজনই কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছি। এই পৃথিবীর হৃদয়হীনতা কেউই সহ্য করতে পারছি না। বড়মামা উপদেশ দিতে দিতে নিয়ে যাচ্ছেন–বিদ্যা অমূল্য ধন, পড়াশোনা করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে-এইসব।
অমূল্য ধন বা গাড়ি-ঘোড়া কোনোকিছুরই প্রতি আকর্ষণ বোধ করছি না।
বড়মামা আমাদের চোখের জল অগ্রাহ্য করে স্কুলে ভরতি করিয়ে দিলেন। শুধু তা-ই নয়, হেডমাস্টার সাহেবকে বললেন, আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে আমি বিনা বেতনে আপনাদের স্কুলে পড়াব। আপাতত আমার কিছু করার নেই, হাতে প্রচুর অবসর।
হেডমাস্টার রাজি হলেন। আমি খানিকটা আশার আলো দেখতে পেলাম। যা-ই হোক, একজন স্যার হলেন আমাদের নিজেদের লোক এবং অতি প্রিয় মানুষ। স্কুলের দিনগুলি হয়তো খারাপ যাবে না। দ্বিতীয় দিনেই বড়মামা আমাদের ক্লাসে অঙ্ক করাতে এলেন। আমি হাসিমুখে চেঁচিয়ে উঠলাম-বড়মামা?