বিকেলগুলিও কম রোমাঞ্চকর ছিল না। প্রতিদিনই বাবা কাঁধে গুলিভরা বন্দুক নিয়ে বলতেন—চল বনে বেড়াতে যাই। কাধে বন্দুক নেয়ার কারণ হচ্ছে প্রায়ই বাঘ বের হয়। বিশেষ করে চিতাবাঘ।
বাবার সঙ্গে সন্ধ্যা পর্যন্ত বনে ঘুরতাম। ক্লান্ত হয়ে ফিরতাম রাতে। ভাত খাওয়ার আগেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসত। কত বিচিত্র শব্দ আসত বন থেকে। আনন্দে এবং আতঙ্কে শিউরে শিউরে উঠতাম।
সবাই ঘুমুতাম একটা ঘরে। বিশাল তিনটা খাট একত্র করে ফুটবলের মাঠের আকৃতির একটা বিছানা তৈরি করা হত। বিছানার উপরে সেই ম্যাপ তৈরি এক মশারি। রাতে বাথরুম পেলে মশারির ভেতর থেকে নামা নিষিদ্ধ ছিল কারণ খুব কাঁকড়াবিছা এবং সাপের উপদ্রপ।
কাঁকড়াবিছাগুলি সাপের মতোই মারাত্মক। একবার কামড়ালে বাচ্চার মা। নেই, এমনি তার বিষ। মৃত্যু সঙ্গে নিয়ে কাড়াবিছা মেঝেতে হেঁটে হেঁটে যাচ্চে আমি বিছানায় বসে মুগ্ধ হয়ে দেখছি-এই ছবি এখনও চোখে ভাসে।।
আমাদের আশেপাশে কোনো জনমানব ছিল না। অনেক দূরে বনের ভেs একজন কম্পাউন্ডার থাকতেন। সভ্য মানুষ বলতে তিনিই। তার বড় মেয়েটির নাম আরতি। আমার বয়সী, বিচিত্র স্বভাবের মেয়ে। দেবী প্রতিমার মতো শান্ত মুখশ্রী, কিন্তু সেই শ্রীময়ী চেহারার সঙ্গে স্বভাবের কোনো মিল নেই। একদিন সকালে আমাদের বাসার সামনে এস মিহি সুরে ডাকতে লাগল-কাজল, এই কাজল!
আমি বের হয়ে এলাম। যেন কত দীর্ঘদিনের চেনা সেই ভঙ্গিতে বলল, বনে বেড়াতে যাবে। উচ্চরণ বিশুদ্ধ শান্তিপুরী। গলার স্বরটিও ভারি মিষ্টি। আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, হ্যাঁ।
সে আমাকে নিয়ে বনে ঢুকে গেল। ক্রমেই সে ভেতরের দিকে যাচ্ছে। আমি একসময় শঙ্কিত হয়ে বললাম, ফেরার পথ মনে আছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে এমনভাবে হাসল যে এরকম অদ্ভুত কথা কখনো শোনেনি। তার পরই হঠাৎ একটা দৌড় দিয়ে উধাও হয়ে গেল।
আমি ভাবলাম, নিশ্চয় লুকোচুরি জাতীয় কোনো খেলা। আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা। আমি খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে করতে কাতর গলায় ডাকতে লাগলাম-আরতি, এই আরতি।
তার কোনো খোঁজ নেই। এই অদ্ভুত মেয়ে আমাকে বনে রেখে বাসায় চলে গেছে।
আমি পথ খুঁজে বের করতে গিয়ে আরও গভীর বনে ঢুকে পড়লাম। একসময় দিশাহারা হয়ে কাদতে বসলাম। জনৈক কাঠকুড়ানো সাঁওতাল যুবক এই অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করে বাসায় দিয়ে আসে।
এর দিন পাঁচেক পর আরতি আবার এসে ডাকতে লাগল—এই কাজল, এই- আমি বের হওয়ামাত্র বলল, বনে যাবে?
আমি খুব ভালো করে জানি, এই মেয়ে আমাকে আবার আগের দিনের মতো গভীর জঙ্গলে ফেলে দিয়ে চলে আসবে। তবু তার আহ্বান উপেক্ষা করতে পারলাম না। পরে যা হবার হবে। আপাতত খানিকক্ষণ এই রূপবতী পাগলি মেয়ের সঙ্গে থাকা যাক। সেদিনও সে তা-ই করল। এর জন্যে তার উপর আমার কোনোরকম রাগ হল না। বরং মনে হল এই মেয়েটির পাশাপাশি থাকার নিয়য়ে আমি আমার সমস্ত পৃথিবী দিয়ে দিতে পারি। এই মোহকে কী বলা যায়? প্রেম? প্রেম সম্পর্কে ফ্রয়েডের ব্যাখ্যা তো এখানে খাটে না। তা হলে এই প্রচণ্ড মোহের জন্ম কোথায়? আমি জানি না। শুধু জানি, মেয়েটির বাবা একদিন তার পরিবার-পরিজন নিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে রাতের অন্ধকারে ইন্ডিয়া চলে যান। এই খবর পেয়ে গভীর শোকে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি। মা যখন জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? আমি বললাম, পেটে ব্যথা। বলে আরও উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলাম। পেটব্যথার অষুধ হিসেবে পেটের নিচে বালিশ দিয়ে আমাকে সারাদিন উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে হল। বাবা আমাকে দুফোটা বায়োকেমিক অষুধ দিলেন। তখন তিনি বায়োকেমিক অষুধ নিয়ে খুব মেতেছেন। চমৎকার একটা ব্যাগে তার অষুধ থাকে। বারোটা শিশির বারো রকমের অষুধ। পৃথিবীর সব রোগব্যাধি এই শিশির ঔষধে আরোগ্য হয়। অনেকটা হোমিওপ্যাথির মতো। তবে হোমিওপ্যাথিতে যেমন অষুধের সংখ্যা অনেক, এখানে মাত্র বারোটা।
বাবার বায়োকেমিক চিকিৎসায় আমার বিরহব্যথা অনেকটা দূর হল। এই পৃথিবীতে কিছুই স্থায়ী নয়-এমন মনোভাব নিয়ে বিছানা থেকে নামলাম। কিছুক্ষণের ভেতরই আবার বিছানায় উঠতে হল। কারণ কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। বাবা-মা দুজনেরই মুখ শুকিয়ে গেল-লক্ষণ ভালো নয়। নিশ্চয় ম্যালেরিয়া। সেই সময়ে এই অঞ্চলে ম্যালেরিয়া কুখ্যাত ছিল। একবার কাউকে ধরলে তার জীবনীশক্তি পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিত। ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। আমরা প্রতিষেধক হিসেবে বায়োকেমিক ওষুধ ছাড়াও প্রতি ররিবারে পাঁচ গ্রেন করে কুইনাইন খাচ্ছি। তার পরও ম্যালেরিয়া ধরবে কেন?
বাবা এই ভয়ংকর জায়গা থেকে বদলির জন্য চেষ্টা-তদবির করতে লাগলেন। শুনে আমার মন ভেঙে গেল। এত সুন্দর জায়গা, এমন চমৎকার জীবন-এসব ছেড়ে কোথায় যাব? ম্যালেরিয়ায় মরতে হলেও এখানেই মরব। তা ছাড়া ম্যালেরিয়া অসুখটা আমার বেশ পছন্দ হল। যখন জ্বর আসে তখন কী প্রচণ্ড শীতই-না লাগে! শীতের জন্যেই বোধহয় শরীরে একধরনের আবেশ সৃষ্টি হয়। জুর যখন বাড়তে থাকে তখন চোখের সামনের প্রতিটি জিনিস আকৃতিতে ছোট হতে থাকে। দেখতে বড় অদ্ভুত লাগে। একসময় নিজেকে বিশাল দৈত্যের মতো মনে হয়। কী আশ্চর্য অনুভূতি।
শুধু আমি একা নই, পালা করে আমরা সব ভাইবোন জ্বরে পড়তে লাগলাম। একজন জ্বর থেকে উঠতেই অন্যজন জ্বরে পড়ে। জ্বর আসেও খুব নিয়মিত। আমরা সবাই জানি কখন জ্বর আসবে। সেই সময়ে লেপ-কাঁথা গায়ে জড়িয়ে আগেভাগেই বিছানায় শুয়ে পড়ি।