টিভি এবং খবরের কাগজে প্রায়ই এরকম খবর আসে। গত বছর উনিশ বছর বয়সী একটা মেয়ে মন্টানার এক বনে হারিয়ে যায়। তাকে উদ্ধার করা হয় তের দিন পরে। সে এই তের দিন ব্যাঙ, সাপ-খোপ লতাপাতা খেয়ে বেঁচে ছিল। কেউ কেউ ইচ্ছে করেই বনে থেকে যায়। তেত্রিশ দিন পর হারিয়ে যাওয়া এক দম্পতিকে খুঁজে বের করার পর তারা বলেন–নাগরিক সভ্যতায় অতিষ্ঠ হয়ে তারা বনে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা ভালোই আছেন। শহরে ফিরতে চান না।
ন বছর বয়সী শিশুটির নিশ্চয়ই এরকম কোনো সমস্যা নেই। সে নিশ্চয়ই আতঙ্কে অস্থির হয়ে আছে। ক্যাম্পে সাজসাজ রব পড়ে গেল এস্টেট পুলিশকে খবর দেওয়া হলো। ঘন্টা খানিকের মধ্যে দুটি হেলিকপ্টার বনের উপর দিয়ে চক্রাকারে উড়তে লাগল। হেলিকপ্টার থেকে জানানো হলো বাচ্চাটিকে দেখা যাচ্ছে। একটা ফাঁকা জায়গায় আছে, নিজের মনে খেলছে। ভয়ের কিছু নেই।
বাচ্চাটিকে যখন উদ্ধার করা হলো, সে গম্ভীর গলায় বলল, আমি হারাব কেন? আমার পকেটে তো কম্পাস আছে।
দুদিন থাকবার পরিকল্পনা নিয়ে গিয়েছিলাম, এক সপ্তাহ থেকে গেলাম। মিসেস সিমসন একদিন এসে বললেন, তোমরা আর থেকো না। বেশিদিন থাকলে নেশা ধরে যাবে। আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করবে না। এই আমাদের দেখ, বছরের পর বছর এই জায়গায় পড়ে আছি। ঘণ্টা খানিকের জন্যও শহরে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মিসেস সিমনস বললেন, সতেরো বছর আগে আমিও আমার স্বামীর সঙ্গে ক্যাম্পিং-এ এই জায়গায় এসেছিলাম। এতই ভালো লাগল যে, লিজ নিয়ে ক্যাম্পিং স্পট বানালাম। তারপর থেকে এখানেই আছি। বছরে তিনটা মাস লোকজনের দেখা পাই, তারপর দুজনে একা একা কাটাই।
কষ্ট হয় না?
না। বনের অনেক রহস্যময় ব্যাপার আছে। তোমরা যারা দু’একদিনের জন্য আস, তারা তা ধরতে পার না। আমরা পারি। পারি বলেই…
মিসেস সিমসন তার কথা শেষ করলেন না। আমি বললাম, রহস্যময় ব্যাপারগুলি কি?
ঐ সব তোমরা বিশ্বাস করবে না। ঐ প্রসঙ্গ বাদ থাক।
তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বনের দিকে তাকালেন। রহস্যময় বন হয়ত কানে কানে তাঁকে কিছু বলল। দেখলাম তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
মিসেস সিমসন বললেন, একটা মজার ব্যাপার কি জান? সমুদ্র মানুষকে আকর্ষণ করে। এত যে সুন্দর সমুদ্র তার পাশেও তিন চার দিনের বেশি মানুষ থাকতে পারে না। আর বন মানুষকে আকর্ষণ করে। মানুষকে সে চলে যেতে দেয় না। পুরোপুরি গ্রাস করতে চেষ্টা করে। কাজেই তোমরা চলে যাও।
আমরা চলে গেলাম। সব মিলিয়ে সাত দিন ছিলাম। মিসেস সিমসন তিন দিনের ভাড়া রাখলেন। শান্ত গলায় বললেন, তোমরা তিন দিন থাকতে এসেছিলে সেই তিন দিনের রেন্টই আমি রেখেছি। বাকি দিনগুলি কাটিয়েছ অতিথি হিসাবে। বনের অতিথি। বন তোমাদের আটকে রেখেছে। কাজেই সেই চার দিনের ভাড়া রাখার কোনো প্রশ্ন ওঠে না।
জগদলের দিন
আমার শৈশবের অদ্ভুত স্বপ্নময় কিছুদিন কেটেছে জগদলে। জগদলের দিন আনন্দময় হবার অনেকগুলি কারণের প্রধান কারণ স্কুলের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। সেখানে কোনো স্কুল নেই। কাজেই পড়াশোনার যন্ত্রণা নেই। মুক্তির মহানন্দ।
আমরা থাকি এক মহারাজার বসতবাড়িতে, যে-বাড়ির মালিক অল্প কিছুদিন আগেই দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়াতে চলে গেছেন। বাড়ি চলে এসেছে পাকিস্তান সরকারের হাতে। মহারাজার বিশাল এবং প্রাচীন বাড়ির এক তার বাবা। দুতলাটা তালাবদ্ধ। শুধু দুতলা নয়, কয়েকটা ঘর ছাড়া বাকি সবটা তালাবদ্ধ। কারণ মহারাজা জিনিসপত্র কিছুই নিয়ে যাননি। ঐসব ঘরে তার জিনিসপত্র রাখা।
ঐ মহারাজার নাম আমার জানা নেই। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনিও বলতে পারলেন না। তবে তিনি যে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ছিলেন তার অসংখ্য প্রমাণ এই বাড়িতে ছড়ানো। জঙ্গলের ভেতর বাড়ি। সেই বাড়িতে ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা করার জন্য তাঁর ছিল নিজস্ব জেনারেটর। দাওয়াতের চিঠি ছেপে পাঠানোর জন্যে মিনি সাইজের একটা ছাপাখানা।
বাবাকে অসংখ্যবার বলতে শুনেছি-মহারাজার রুচি দেখে মুগ্ধ হতে হয়। আহা, কত বই! কত বিচিত্র ধরনের বই।
বাবা অনেক লেখালেখি করলেন, যাতে বইগুলি অন্তত সরকারি পর্যায়ে সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়। তাঁর লেখালেখিতে কোনো কাজ হল না। বাবা কতবার যে গভীর বেদনায় বললেন-আহা, চোখের সামনে বইগুলো নষ্ট হচ্ছে, কিছু করতে পারছি না! তিনি ইচ্ছা করলেই সমস্ত বই নিজের সংগ্রহে যুক্ত করতে পারতেন। তাতে বইগুলি রক্ষা পেত। তিনি তা করলেন না। পরের জিনিস নিজের মনে করার প্রশ্নই আসে না। তিনি হাহুতাশ করতে লাগলেন। চোখের সামনে বই নষ্ট হতে লাগল। হোক নষ্ট, তাতে আমাদের অর্থাৎ ছোটদের তেমন কিছুই যায় আসে না। কারণ আমাদের সামনে অন্য একটি জগৎ খুলে গেছে।
বাড়ির সামনে বিশাল বন। একটু দূরেই নদী, যে-নদীর পানি কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ। নদীর তীরে বালি ঝিকমিক করে জ্বলে। নদীটিই পাকিস্তান এবং ইন্ডিয়ার সীমানা। সারাক্ষণ অপেক্ষা করতাম কখন দুপুর হবে-নদীতে যাব গোসল করতে। একবার নদীতে নামলে ওঠার নাম নেই। তিন ভাইবোন নদীতে ঝাপাঝাঁপি করছি, বড়রা হয়তো একজনকে জোর করে ধরে পাড়ে নিয়ে রাখল। আনতে গেল অন্যজনকে। এই ফাঁকে পাড়ে যে আছে সে লাফিয়ে নামল।