শেষে ফেলুদা আর থাকতে না পেরে লাইন যোগ করতে শুরু করে দিল—ওরে তোরা কি জানিস কেউ, কেন বাঘ এলে ডাকে ফেউ…ওরে তোরা কি শুনিস কেউ, কুকুরের ঘেউ ঘেউ, খোকা কাঁদে ভেউ ভেউ…
গুপ্তকাশী যখন পৌঁছলাম, তখন বেজেছে দশটা। এখানে একটা চায়ের দোকান দেখে থামতে হল। যাকে ব্রেকফাস্ট বলে সেটা সকালে হয়নি, কাজেই খিদেটা ভালই হয়েছিল। গরম জিলিপি, কচুরি আর চা দিয়ে দিব্যি ব্রেকফাস্ট হয়ে গেল।
যোগীন্দরের এক ভাই কাছেই থাকে, সে বলল তার সঙ্গে পাঁচ মিনিটের জন্য দেখা করে আসছে। সেই ফাঁকে লালমোহনবাবু চন্দ্ৰশেখর মহাদেব আর অর্ধনারীশ্বরের মন্দিরগুলো দেখতে গেলেন।
গুপ্তকাশী থেকে পাহাড়ের উপর দেখা যায় উধীমঠ। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কেদারের পথ যখন বরফের জন্য বন্ধ থাকে, তখন কেদারেশ্বরের পুজো এই উখীমঠেই হয়ে থাকে।
লালমোহনবাবু মন্দির দেখে ফিরে এলেন, কিন্তু যোগীন্দরের ফেরার নাম নেই। ফেলুদা আর আমি ব্যস্তভাবে এদিক-ওদিক দেখছি। এমন সময় দেখি, ছোটকুমারের গাড়ি আসছে। ওরা আমাদের পেরিয়ে গিয়ে আবার পিছিয়ে পড়ল কেন?
আমাদের দেখে গাড়ি থামিয়ে কুমার নেমে এলেন। বললেন, গুপ্তকাশী থেকে নাকি কেদার ও বস্ত্রী দুটো চূড়েরই ভিউ পাওয়া যায়, তাই ওঁরা এখানে কিছুটা সময় দিলেন। তবে আর দেরি করলে চলবে না, কারণ তা হলে যাত্রীদের রওনা দেবার দৃশ্য তোলার জন্য আর আলো থাকবে না।
কিন্তু তাও যোগীন্দরের দেখা নেই। তার বদলে দেখা দিলেন সাংবাদিক মিঃ। ভার্গব। তাঁর গাড়িটা আগে দেখেছিলাম, আর ভাবছিলাম। তিনি এখানে এতক্ষণ কী করছেন। ভদ্রলোক বললেন যে, কেদারনাথের সেবায়েতের একজন নাকি এখানে রয়েছেন। এরা সকলেই রাওয়াল পরিবারের লোক; এই বিশেষ রাওয়ালটির সঙ্গে নাকি একটা ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলেন মিঃ। ভার্গব। এখনই আবার তাঁকে ছুটতে হবে শোনপ্ৰয়াগ হয়ে গৌরীকুণ্ড।
মিঃ ভার্গব চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে একটা বছর পনেরোর ছেলে এসে হঠাৎ ফোর-থাটি-ফোর ট্যাক্সি কি কোই পাসিঞ্জর হ্যায় হ্যাঁ? বলে হাঁক দিতেই ফেলুদা ব্যস্তভাবে তার দিকে এগিয়ে গেল।
ফোর-থ্রি-জিরো-ফোর কি পাসিঞ্জর?
হ্যাঁ। কেন, কী হয়েছে?
ব্যাপার আর কিছুই না, আমাদের গাড়ির ড্রাইভার জখম হয়ে পড়ে আছে কিছু দূরে। ছেলেটি তাকে চেনে বলে সে খবর দিতে এসেছে।
লালমোহনবাবুকে আমাদের জিনিসপত্র পাহারা দেবার জন্য রেখে, আমরা দুজন ছেলেটাকে অনুসরণ করে গেলাম।
পাঁচ-সাতটা বাড়ি নিয়ে একটা নিরিবিলি পাড়ায় একটা কলাগাছের ধারে যোগীন্দরীরাম মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। তার মাথার পিছন দিকের ঘন কালো চুলে রক্তের ছাপ। শরীরের ওঠা-নমা থেকে বোঝা যাচ্ছে সে মরেনি, কিন্তু ফেলুদা তাও দৌড়ে গিয়ে তার নাড়ি পরীক্ষা করল।
কে এই কুকীর্তি করেছে, এ নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই; এখন দরকার ওর চিকিৎসা। ছাকরাটি বলল, এখানে হাসপাতাল দাওয়াখানা দুইই আছে। সে আবার গাড়িও চালাতে জানে। শেষ পর্যন্ত সে-ই নিজে ট্যাক্সি চালিয়ে যোগীন্দরকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।
সব মিলিয়ে ঘণ্টা দেড়েক দেরি হয়ে গেল! যোগীন্দরের মাথায় ব্যান্ডেজ, ব্যথাও আছে; তাকে বলা হল যে এখান থেকে অন্য ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিলে, আমরা তাতেই যাব। কিন্তু সে রাজি হল না। সে নিজেই যাবে আমাদের নিয়ে।
কে মেরেছিল, কিছু বুঝতে পেরেছিলে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
নেহি, বলল যোগীন্দর, পিছে সে আ করা মারা।
এখানে তোমার কোনও দুশমন আছে?
কেই ভি নেহী।
ফেলুদা কী ভাবছে সেটা আমি জানি। দুশমন। যদি থাকে তো সে আমাদের দুশমন। আমাদের দেরি করিয়ে দেবার জন্য ব্যাপারটা করা হয়েছে। শত্রু কে আমরা বুঝতে না পারলেও, শত্রু যে রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
আমরা রওনা হবার পর আমি ফেলুদাকে বললাম, আচ্ছা, মিঃ পুরী যে তোমার কাছে এসেছিলেন, সেটা জানতে পেরে ছোটকুমার তাঁকে দিয়ে টেলিগ্রামটা করিয়ে চিঠিটা লেখায়নি। তো?—যাতে তার কাজে ফেলুমিত্তির কোনও বাধার সৃষ্টি না করতে পারে?
এটা তুই খুব ভাল ভেবেছিস তোপ্সে। কথাটা আমারও মনে হয়েছে। অবিশ্যি তার মানে এটাও বোঝা যায় যে, মিঃ পুরীর উপর এতটা কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা ছোটকুমারের আছে।
তা থাকবে না কেন, বললেন লালমোহনবাবু, ছেট্ৰকুমার ইজ এ প্রিন্স, অ্যান্ড পুরী ইজ ওনলি এ কর্মচারী।
ঠিক বলেছেন। আপনি, বলল ফেলুদা, এখানে বয়সের তফাতটা কিছু ম্যাটার করে না।
তবে হ্যাঁ-এটাও ঠিক যে টেলিগ্রাম আর চিঠি সত্ত্বেও যে আমি চলে আসব, সেটা বোধহয় ছোট কুমার ভাবতেই পারেনি।
তার মানে যোগীন্দরকে জখম ওরাই করিয়েছে?
যোগীন্দর যখন বলছে এখানে ওর কোনও শত্রু নেই, তখন আর কী হতে পারে?
এক্সকিউজ মি স্যার, বললেন লালমোহনবাবু, আমার কিন্তু ওই সাংবাদিক লোকটিকেও বিশেষ সুবিধের লাগছে না।
কেন বলুন তো? আমার নিজেরও যে ভদ্রলোককে একেবারে আদর্শ চরিত্র বলে মনে হচ্ছে তা নয়। কিন্তু আপনার ভাল না-লাগার কারণটা জানার কৌতুহল হচ্ছে।
সাংবাদিক হলে পকেটে কলম থাকবে না? বললেন লালমোহনবাবু।বাইরের পকেটে তো নেই-ই, কাল যখন কোিট পরছিল তখন দেখলাম বুক পকেটেও নেই, শার্টের পকেটেও নেই।
আমার মতো যদি একটা মাইক্রোক্যাসেট রেকর্ডার থাকে?
লালমোহনবাবু যেন কথাটা শুনে একটু দামে গেলেন। বললেন, তা যদি হয়, তা হলে অবশ্য আলাদা কথা। আসলে আমার চাপ-দাড়ি দেখলেই কেমন যেন একটা সন্দেহ হয়।