- বইয়ের নামঃ এবার কাণ্ড কেদারনাথে
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই, ফেলুদা সমগ্র
০১. কী ভাবছেন ফেলুবাবু
কী ভাবছেন, ফেলুবাবু?
প্রশ্নটা করলেন রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে জটায়ু। আমরা তিনজনে রবিবারের সকালে আমাদের বালিগঞ্জের বৈঠকখানায় বসে আছি, লালমোহনবাবু যথারীতি তার গড়পারের বাড়ি থেকে চলে এসেছেন গল্পগুজবের জন্য। কিছুক্ষণ হল এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, কিন্তু এখন গনগনে রোদ। রবিবার লোডশেডিং নেই বলে আমাদের পাখাটা খুব দাপটের সঙ্গে ঘুরছে।
ফেলুদা বলল, ভাবছি আপনার সদ্যপ্রকাশিত উপন্যাসটার কথা।
পয়লা বৈশাখ জটায়ুর অতলান্তিক আতঙ্ক বেরিয়েছে, আর আজ পাঁচই বৈশাখের মধ্যেই নাকি সাড়ে চার হাজার কপি বিক্রি হয়ে গেছে।
লালমোহনবাবু বললেন, ও বইতে যে আপনার মতো লোকের ভাবনার খোরাক ছিল, তা তো জানতুম না মশাই।
ঠিক সে রকম ভাবনা নয়।
তবে?
ভাবছিলাম। আপনার গল্প যতই গাঁজাখুরি হোক না কেন, স্রেফ মশলা আর পরিপাকের জোরে শুধু যে উতরে যায় তা নয়, রীতিমতো উপাদেয় হয়।
লালমোহনবাবু গদগদ ভাব করে কিছু বলার আগেই ফেলুদা বলল, তাই ভাবছিলাম আপনার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কোনও গল্প লিখিয়ে-টিখিয়ে ছিলেন কি না।
সত্যি বলতে কী, আমরা লালমোহনবাবুর পূর্বপুরুষদের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানি না। উনি বিয়ে করেননি এবং ওঁর বাপ-মা আগেই মারা গেছেন সেটা জানি, কিন্তু তার বেশি উনিও বলেননি, আর আমরাও কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
লালমোহনবাবু বললেন, পাঁচ-সাত পুরুষ। আগের কথা তো আর বিশেষ জানা যায় না, তাঁদের মধ্যে হয়তো কোনও কথক ঠাকুর-টাকুর থেকে থাকতে পারেন। তবে গত দু-তিন জেনারেশনের মধ্যে ছিল না সেটা বলতে পারি।
আপনার বাবার আর ভাই ছিল না?
থ্রি ব্রাদার্স। উনি ছিলেন মিড্ল। জ্যাঠা মোহিনীমোহন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন। ছেলেবেলায় আরনিক রাসটিকস বেলাডোনা পালসেটিলা যে কত খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার ললিতমোহন ছিলেন পেপার মার্চেন্ট। এল এম গাঙ্গুলী অ্যান্ড সন্যসের দোকান এই সেদিন অবধি ছিল। ভাল ব্যবসা ছিল। গড়পারের বাড়িটা এল-এমই তৈরি করেন। ঠাকুরদাদা, বাবা দুজনেই ব্যবসায় যোগ দেন। বাবা যদিন বেঁচে ছিলেন। তিদিন ব্যবসা চালান। ফিফটি-টু-তে চলে গেলেন। তার পর যা হয়। আর কী। এল এম গাঙ্গুলী অ্যান্ড সনস-এর নামটা ব্যবহার হয়েছিল কিছু দিন, কিন্তু মালিক বদল হয়ে গেছিল।
আপনার ছোটকাকা? তিনি ব্যবসায় যোগ দেননি?
নো স্যার। ছোটকাকা দুৰ্গমোহনকে দেখি আমার জন্মের অনেক পরে। আমার জন্ম থার্টি সিক্সে। দুগামোহন টোয়েন্টি নাইনে সন্ত্রাসবাদীদের দলে যোগ দিয়ে খুলনার অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার টার্নবুল সাহেবকে গুলি মেরে তাঁর থুতনি উড়িয়ে দেন।
তার পর?
তারপর হাওয়া। বেপাত্তা। পুলিশ ধরতে পারেনি ছাটকাকাকে। আমরা ধারণা আমার অ্যাডভেঞ্চার প্রীতিটা ছোটকাকার কাছ থেকেই পাওয়া।
উনি আর আসেননি?
এসেছিলেন। একবার। স্বাধীনতার পর ফর্টি নাইনে। তখন আমি থার্ড ক্লাসে পড়ি। সেই প্রথম আর সেই শেষ দেখা ছোটকাকার সঙ্গে। তবে যাঁকে দেখলাম, তিনি সেই অগ্নিযুগের ছাটকাকা দুগামোহন গাঙ্গুলী নন। কমপ্লিট চেঞ্জ। কোথায় সন্ত্রাস, কোথায় পিস্তল। একেবারে নিরীহ, সাত্ত্বিক পুরুষ। মাসখানেক ছিলেন, তার পর আবার চলে যান।
কোথায়?
যদ্দুর মনে পড়ে কোনও জঙ্গলে কাঠের ব্যবসা করতে যান।
বিয়ে করেননি?
নাঃ।
কিন্তু আপনার আপনি বা জ্যাঠতুতো ভাইবোন আছে নিশ্চয়ই।
আপনি বোন একটি আছেন, দিদি। স্বামী রেলওয়েতে চাকরি করেন; ধানবাদে পোস্টেড। জ্যাঠার ছেলে নেই, তিন মেয়ে, তিনজনের স্বামীই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। বিজয়া দশমীতে একটি করে পোস্টকার্ড—ব্যস। আসলে রক্তের সম্পর্কটা কিছুই নয়, ফেলুবাবু। এই যে আপনার আর তাপেশের সঙ্গে আমার ইয়ে, তার সঙ্গে কি ব্লাড রিলেশনের কোনও—?
লালমোহনবাবুর কথা থামাতে হল, কারণ দরজায় টাকা পড়েছে। এটা যাকে বলে প্রত্যাশিত, কারণ টেলিফোনে অ্যাপেয়ন্টমেন্ট করা ছিল। সাড়ে নটার জন্য, এখন বেজেছে ন’টা তেত্ৰিশ।
ভদ্রলোকের নামটা জানা ছিল টেলিফোনে—উমাশঙ্কর পুরী—এবার চেহারাটা দেখা গেল। মাঝারি হাইট, দোহারা গড়ন, পরনে ঘি রঙের হ্যান্ডলুমের সুট। দাড়ি-গোঁফ। কামানো। মাথার চুল কাঁচা-পাকা মেশানো, ডান দিকে সিঁথি। এই শেষের ব্যাপারটা দেখলেই কেন যেন আমার আসোয়াস্তি হয়; মনে হয় মুখটা যেন আয়নায় দেখছি। পুরুষদের মধ্যে শতকরা একজনের বেশি ডান দিকে সিঁথি করে কিনা সন্দেহ, যদিও কারণটা জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব না।
আপনাকে খুব তাড়াহুড়ো করে চলে আসতে হয়েছে বলে মনে হচ্ছে? ফেলুদা মন্তব্য করল। আলাপ পর্বের পর ভদ্রলোক চেয়ারে বসতেই।
হ্যাঁ, তা— উমাশঙ্করের ভুরু কপালে উঠে গেল—কিন্তু সেটা আপনি জানলেন কী করে?
আপনার বাঁ হাতের সব নখই পরিষ্কার করে ক্লিপ দিয়ে কাটা, তার একটি নখ এখনও কোটের পকেটের ধারে লেগে আছে, অথচ ডান হাতে দুটো নখের পরে আর বাকিগুলো…
আর বলবেন না। বললেন মিঃ পুরী, ঠিক সেই সময় একটা ট্রাঙ্ক কল এসে গেল; কথা শেষ হতে দেখি, আপনার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় হয়ে গেছে।