- বইয়ের নামঃ কৈলাসে কেলেঙ্কারি
- লেখকের নামঃ সত্যজিৎ রায়
- বিভাগসমূহঃ ফেলুদা সমগ্র
০১. জুন মাসের মাঝামাঝি
জুন মাসের মাঝামাঝি। স্কুল ফাইনাল দিয়ে বসে আছি, রেজাল্ট কবে বেরোবে জানি না। আজ সিনেমায় যাবার কথা ছিল, কিন্তু ঠিক দুটো বাজতে দশ মিনিটে এমন তেড়ে বৃষ্টি নামল যে সে আশা ত্যাগ করে একটা নতুন কেনা টিনটিনের বই নিয়ে বৈঠকখানায় তক্তাপোশে বসে বেশ মশগুল হয়ে পড়ছি! টুনটুনির বই না, টিনটিনের বই। টিনটিন ইন টিবেট। বেলজিয়াম থেকে ফরাসি ভাষায় বেরোয় এই আশ্চর্য কমিক বই। তারপর পৃথিবীর নানান ভাষায় অনুবাদ হয়। এখানে আসে ইংরেজিটা। আমার আর ফেলুদার দুজনেরই মতে রহস্য রোমাঞ্চ সাসপেন্স আর হাসিতে ভরা এর চেয়ে ভাল কমিক বই আর নেই। এর আগে আরও তিনটে কিনেছি, এটা নতুন, প্রথমে আমি পড়ব, তারপর ফেলুদা। ও এখন সোফায় কগত হয়ে শুয়ে দ্য চ্যারিয়ট অফ দ্য গড়স বলে একটা বই পড়ছে। পড়ছে মানে, একটু আগেও পড়ছিল, এখন শেষ করে সেটা বুকের ওপর রেখে সিলিঙে ঘুরন্তু পাখাটার দিকে চেয়ে আছে। মিনিটখানেক। এইভাবে তাকিয়ে থেকে বলল, গিজার পিরামিডে কাটা পাথরের ব্লক আছে জানিস? দুই লক্ষ।
বেশ। জানলাম। কিন্তু ফেলুদা হঠাৎ কেন পিরামিড নিয়ে পড়েছে বুঝলাম না। ফেলুদা বলে চলল, এই ব্লকের এক একটার ওজন প্রায় পনেরো টন। সে যুগের এঞ্জিনিয়ারিং সম্বন্ধে যা আন্দাজ করা যায় তার সাহায্যে দিনে দশটার বেশি ব্লক নিখুঁতভাবে পালিশ করে ঠিক জায়গায় নিখুঁতভাবে বসানো মিশরীয়দের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া যেখানে পিরামিড, তার ত্ৰিসীমানায় ওই পাথর নেই। সে পাথর আসত নীকো করে, নাইল নদীর ওপর থেকে। সাধারণ বুদ্ধিতেও হিসেব করলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায় জানিস? ওই একটি পিরামিড তৈরি করতে সময় লেগেছিল কমপক্ষে ছশো বছর।
ভাববার কথা বটে। বললাম, এটা কি ওই বইয়ে লিখেছে?
শুধু এটা নয়। প্রাচীন কালের আরও অনেক আশ্চর্য কীর্তির কথা এতে আছে যেগুলো কী করে সম্ভব হয়েছিল তা প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলেন না, বা বলার চেষ্টাও করেন না। আমাদের দেশেই দেখ না। দিল্লিতে কুতুবমিনারের পাশে যে লৌহস্তম্ভ আছে তাতে দু হাজার বছরেও মরচে ধরেনি কেন? ইস্টার আইল্যান্ডের নাম শুনেছিস? দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে একটা ছোট্ট দ্বীপ। সেই দ্বীপে গেলে দেখা যায়, কোন আদ্যিকালে কারা জানি পেল্লায় সব মানুষের মাথা পাথরে খোদাই করে সমুদ্রের দিকে মুখ করিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। পাথর আছে দ্বীপের মাঝামাঝি; মাথাগুলো এনে রাখা হয়েছে সেখান থেকে পাঁচ-সাত মাইল দূরে। একেকটার ওজন প্রায় পঞ্চাশ টন। জংলি লোকে কী করে এ জিনিসটা করল? লরি, ক্রেন, ট্রাকটর, বুলডোজার-এ সব তো তখন ছিল না।
ফেলুদা এর মধ্যে একটা চারমিনার ধরিয়েছে। বইটা পড়ে ও যে বেশ উত্তেজিত সেটা বোঝা যাচ্ছিল। এবার সোজা হয়ে উঠে বসে বলল, পেরুতে একটা জায়গায় মাইলের পর মাইল জুড়ে মাটির উপর জ্যামিতিক রেখা আর নকশা কাটা আছে। আদ্যিকাল থেকে সেটার কথা লোকে জানে; প্লেন থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। অথচ কবে কেমন কীভাবে সেগুলো কাটা হল তা কেউ জানে না। রহস্য এতই গভীর যে সেটা নিয়ে কেউ ভাবতেও চায় না।
যিনি ওই বইটা লিখেছেন তিনি ভেবেছেন বুঝি?
প্রচুর ভেবেছেন; আর ভেবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, আজ থেকে বিশ-পঁচিশ হাজার বছর আগে নিশ্চয়ই অন্য কোনও গ্রহ থেকে মানুষের চেয়েও অনেক বেশি উন্নত কোনও প্রাণী পৃথিবীতে এসে মানুষকে তাদের জ্ঞানের খানিকটা অংশ দিয়ে অনেকখানি এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। পিরামিড ইত্যাদি হচ্ছে এই অতিমানবীয় টেকনলজির নিদর্শন, যাকে আজকের মানুষও টেক্কা দিতে পারেনি। কুরুক্ষেত্রে যে সব মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রের কথা বলা হয়েছে তার সঙ্গে আজকের অ্যাটমিক মরণাস্ত্রের মিল তা জানিস তো?
তার মানে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেও কি অন্য গ্রহের প্রাণীরা এসে—
ব্যাপারটা জমে উঠেছিল, কিন্তু আমার কথা শেষ না হতেই বাধা পড়ল। এই বৃষ্টির মধ্যেই কে জানি এসে আমাদের কলিং ষোলটায় পর পর তিনবার সজোরে চাপ দিয়েছে। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই বৃষ্টির ছাঁটের সঙ্গে হুমড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকলেন সিধুজ্যাঠা, আর তাঁর হাতের ছাতাটা ব্যাপাত করে বন্ধ করতেই আরও খানিকটা জল চারপাশে ছিটিয়ে পড়ল।
কী দুর্যোগ কী দুর্যোগ একটু চা বলো তোমার ওই ভাল চা, এক নিশ্বাসে বলে ফেললেন সিধুজ্যাঠা। আমি এক দৌড়ে গিয়ে শ্ৰীনাথকে ঘুম ভাঙিয়ে তিন কাপ চা করতে বলে ফিরে এসে দেখি সিধুজ্যাঠা সোফায় বসে সাংঘাতিক ভূকুটি করে টেবিলের উপরে রাখা চিনে মাটির অ্যাশট্রেটার দিকে চেয়ে আছেন। ফেলুদা বলল, আপনি এই বাদলায় রিকশা না নিয়ে—
মানুষ খুন তো আকছার হচ্ছে; তার চেয়েও সাংঘাতিক খুন কী জান?
ফেলুদা থতামত, চুপ! আমি তো বটেই। যিনি প্রশ্নটা করেছেন তিনিই উত্তর দেবেন।
সেটাও জানি। সিধুজ্যাঠা বললেন, এ কথা সবাই মানে যে, আজকে আমাদের দেশটা উচ্ছন্নে যেতে বসলেও, এককালে অনেক কিছুই এখানে ঘটেছিল যা নিয়ে আজও আমরা গৰ্ব্ব করতে পারি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গর্ব করার বিষয়টা কী জানো তো? সেটা হল। আমাদের শিল্পকলা, যার অনেক নমুনা আমরা আজও চোখের সামনে দেখতে পাই। কেমন, ঠিক কি না?