রুদ্রপ্ৰয়াগ জরুরি দুটো কারণে; এক হল জিম করবেট। দ্য ম্যান-ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্ৰয়াগ যে পড়েছে, সে কোনও দিন ভুলতে পারবে না। কী আশ্চর্য ধৈর্য, অধ্যবসায়, আর সাহসের সঙ্গে করবেট মেরেছিল। এই মানুষখেকোকে আজ থেকে পঞ্চান্ন বছর আগে। আমাদের ড্রাইভার যোগীন্দর বলল, সে ছেলেবেলায় তার বাপ-ঠাকুন্দর কাছে শুনেছে। এই বাঘ মারার গল্প। করবেট যেমন ভালবাসত এই গাড়োয়ালিদের, গাড়োয়ালিরাও ঠিক তেমনই ভক্তি করত করবেটকে।
রুদ্রপ্রয়াগের আর একটা ব্যাপার হচ্ছে—এখান থেকে বস্ত্রী ও কেদার দু জায়গাতেই যাওয়া যায়! দুটো নদী এসে মিশেছে রুদ্রপ্রয়াগে—মন্দাকিনী আর অলকানন্দা। অলকানন্দ ধরে গেলে বন্দ্রীনাথ আর মন্দাকিনী ধরে গেলে কেদারনাথ। বন্দ্রীনাথের শেষ পর্যন্ত বাস যায়; কেদারনাথ যেতে বাস থেমে যায় ১৪ কিলোমিটার আগে গৌরীকুণ্ডে। সেখান থেকে হয় হেঁটে, না হয় ডাণ্ডি বা টাটু ঘোড়া ভাড়া করে যাওয়া যায়।
হৃষীকেশ থেকে বেরিয়েই বনের মধ্য দিয়ে পাহাড়ের পথ আরম্ভ হয়ে গেল। পাশ দিয়ে বয়ে চলছে স্থানীয় লোকেরা যাকে বলে গঙ্গা মাঈ। হৃষীকেশ থেকে রুদ্রপ্ৰয়াগ ১৪০ কিলোমিটার; পাহাড়ে রাস্তায় ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার করে গেলেও সেই সন্ধ্যার আগে পৌঁছানো যাবে না। তা ছাড়া পথে তিনটে জায়গা পড়ে–দেবপ্রয়াগ, কীর্তিনগর, আর শ্ৰীনগর। এই শ্ৰীনগর কাশ্মীরের রাজধানী নয়, গাড়ওয়াল জেলার রাজধানী।
পাহাড় ভেদ করে বনের মধ্য দিয়ে কেটে তৈরি করা রাস্তা ঘুরে ঘুরে উঠছে, আবার ঘুরে ঘুরে নামছে। মাঝে মাঝে গাছপালা সরে গিয়ে খোলা সবুজ পাহাড় বেরিয়ে পড়ছে, তারই কোলে ছবির মতো ছোট ছোট গ্রাম দেখা যাচ্ছে।
দৃশ্য সুন্দর ঠিকই, কিন্তু আমার মন কেবলই বলছে ভবানী উপাধ্যায়ের কাছে একটা মহামূল্য লকেট রয়েছে। একজন সন্ন্যাসীর কাছে এমন একটা জিনিস থাকবে, আর তাই নিয়ে কোনও গোলমাল হবে না, এটা যেন ভাবাই যায় না। তা ছাড়া মিঃ পুরীর একবার ফেলুদাকে কাজের ভার দিয়ে, তার পরই টেলিগ্রাম করে বারণ করাটাও কেমন যেন গণ্ডগোল লাগছে। অবশ্য তিনি চিঠিতে কারণ দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এ জিনিস এর আগে কক্ষনও হয়নি বলেই বোধহয় একটা খটকা মন থেকে যাচ্ছে না।
লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ থেকেই উসখুসি করছিলেন, এবার বললেন, আমি ভূ-গণ্ডগোল আর ইতিহাস-ফাঁসে চিরকালই কাঁচা ছিলাম ফেলুবাবু—সেটা তো আপনি আমার লেখা পড়েও অনেক বার বলেছেন। তাই, মানে, আমরা ভারতবর্ষের এখন ঠিক কোনখানে আছি, সেটা একটু বলে দিলে নিশ্চিন্ত বোধ করব।
ফেলুদা তার বাথোলোমিউ কোম্পানির বড় ম্যাপটা খুলে বুঝিয়ে দিল—এই যে দেখুন হরিদ্বার। আমরা এখন যাচ্ছি। এই দিকে। এই যে রুদ্রপ্রয়াগ। অথাৎ পুবে নেপাল, পশ্চিমে কাশ্মীর, আমরা তার মধ্যিখানে, বুঝেছেন?
হ্যাঁ। এই বারে ক্লিয়ার।
০৩. রুদ্রপ্রয়াগ
পথে শ্ৰীনগরে থেমে চা খেয়ে রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছতে পৌঁছতে হয়ে গেল প্রায় পাঁচটা। ইস্কুল কলেজ হাসপাতাল পোস্টাপিস থানা, সব মিলিয়ে রুদ্রপ্ৰয়াগ বেশ বড় শহর। করবেট যেখানে লেপার্ডটা মেরেছিল, সেখানে অনেক দিন পর্যন্ত নাকি সাইনবোর্ড ছিল, কিন্তু যোগীন্দর বলল, সেটা নাকি কয়েক বছর হল ভেঙে গেছে।
আমরা সোজা চলে গেলাম গাড়ওয়াল নিগম রেস্ট হাউসে। শহরের একটু বাইরে সুন্দর নিরিবিলি জায়গায় তৈরি রেস্ট হাউসে গিয়ে যে খবরটা প্রথমেই শুনলাম, সেটা হল : কেদারনাথের রাস্তায় এক জায়গায় ধস নামাতে নাকি বাস চলাচল বেশ কয়েক দিন বন্ধ ছিল, আজই আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। এতে যে আমাদের একটা বড় রকম সুবিধে হয়েছিল, সেটা পরে বুঝেছিলাম।
ম্যানেজার মিঃ গিরিধারী ফেলুদাকে না চিনলেও আমাদের খুব খাতির করলেন। উনি নাকি হিন্দি অনুবাদে বহু বাংলা উপন্যাস পড়ে খুব বাঙালি-ভক্ত হয়ে পড়েছেন। ওঁর ফেভারিট অথরস হচ্ছেন বিমল মিত্র আর শংকর।
মিঃ গিরিধারী ছাড়াও আরেকজন ভদ্রলোক ছিলেন রেস্ট হাউসে, তিনি কেদারের পথ বন্ধ বলে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। ইনি। কিন্তু ফেলুদাকে দেখে চিনে ফেললেন। বললেন, আমি একজন সাংবাদিক, আমি আপনার অনেক কেসের খবর জানি; সেভেনটি নাইনে এলাহাবাদে সুখতঙ্কর মার্ডার কেসে আপনার ছবি বেরিয়েছিল নদীর্ন ইন্ডিয়া পত্রিকায়। সেই থেকেই আমি আপনাকে চিনেছি। আমার নাম কৃষ্ণকান্ত ভার্গব। আই অ্যাম ভেরি প্রাউন্ড টু মিট ইউ, স্যার।
ভদ্রলোকের বছর চল্লিশেক বয়স, চাপদাড়ি, মাঝারি গড়ন। মিঃ গিরিধারী স্বভাবতই ফেলুদার পরিচয় পেয়ে ভারী উত্তেজিত হয়ে পড়লেন—দেয়ার ইজ নো ট্রাবল হিয়ার আই হোপ?
ট্রাবল্য সর্বত্রই হতে পারে, মিঃ গিরিধারী। তবে আমরা এসেছি। একটা অন্য ব্যাপারে। আপনাদের এখানে ভবানী উপাধ্যায় নামে একজন ভদ্রলোক–
উপাধ্যায় তো এখানে নেই, বলে উঠলেন সাংবাদিক মিঃ ভার্গব। আমি তো ওঁকে নিয়েই একটা স্টোরি করব বলে এখানে এসেছি। হরিদ্ধারে গিয়ে শুনলাম, উনি রুদ্রপ্ৰয়াগ গেছেন; এখন এখানে এসে শুনছি। তিনি খুব সম্ভবত কেদারনাথ গেছেন। আমি তাই কাল সকালে কেদার যাচ্ছি। ওঁর খোঁজে। হি ইজ এ মোস্ট ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার, মিঃ মিটার।
আমি অবিশ্যি ওঁর অসুখ সারানোর কথা শুনেছি, বলল ফেলুদা। তারপর লালমোহনবাবুর দিকে দেখিয়ে চাপা গলায় বলল, আমার এই বন্ধুটির মাঝে মাঝে একটা মস্তিষ্কের ব্যারামের মতো হয়। ভুল বকেন, সামান্য ভায়োলেন্সও প্রকাশ পায়। তাই একবার ওঁকে দেখাব ভাবছিলাম। কলকাতার অ্যালোপ্যাথি হোমিওপ্যাথিতে কোনও কাজ দেয়নি।