আমরা আর সময় নষ্ট না করে বিল চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
কান্তিভাই পণ্ডিতের বয়স ষাট-পয়ষট্টি, বেঁটেখাটো চোখাচাখা ফরসা চেহারা, খোঁচা খোঁচা গোঁফ, কপালে চন্দনের ফোঁটা আর চোখে বাইফোকাল চশমা। আমরা ভবানী উপাধ্যায়ের খোঁজ করছি জেনে উনি রীতিমতো অবাক হয়ে বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো? আর একজন তো ওঁর খোঁজ করে গেলেন এই তিন-চার দিন আগে।
তাঁর চেহারা মনে আছে আপনার?
তা আছে বইকী।
দেখুন তো এই চেহারার সঙ্গে মেলে। কিনা।
ফেলুদা পকেট থেকে ছোটকুমার পবনদেও-এর ছবিটা বার করে দেখাল।
হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো সেই লোক, বললেন। কান্তিভাই পণ্ডিত। আমি রুদ্রপ্রয়াগের ঠিকানা দিয়ে দিলাম তাঁকে।
সে ঠিকানা অবিশ্যি আমরাও চাই, বলে ফেলুদা তার একটা কার্ড বার করে দিল মিঃ পণ্ডিতের হাতে।
কার্ডটা পাওয়ামাত্র মিঃ পণ্ডিতের হাবভাব একদম বদলে গেল। এতক্ষণ আমরা দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, এবার আমাদের সকলকে চেয়ার, মোড়া আর তক্তপোশে ভাগাভাগি করে বসতে দেওয়া হল।
কেয়া, কুছ গড়বড় হুয়া মিঃ মিত্তর?
যত দূর জানি, এখনও হয়নি, বলল ফেলুদা। তবে হবার একটা সম্ভাবনা আছে। এবার আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই, মিঃ পণ্ডিত; আপনি সঠিক উত্তর দিতে পারলে খুব উপকার হবে।
আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট।
মিঃ উপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহে কি কোনও একটা মূল্যবান জিনিস ছিল?
মিঃ পণ্ডিত একটু হেসে বললেন, এ প্রশ্নটাও আমাকে দ্বিতীয়বার করা হচ্ছে। আমি মিঃ সিংকে যা বলেছি, আপনাকেও তাই বলছি। মিঃ উপাধ্যায়ের একটা থলি উনি আমার সিন্দুকে রাখতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে যে কী ছিল, সেটা আমি কোনও দিন দেখিনি বা জিজ্ঞেসও করিনি।
সেটা উনি রুদ্রপ্ৰয়াগ নিয়ে গেছেন?
ইয়েস স্যার। অ্যান্ড অ্যানাদার থিং-আপনি ডিটেকটিভ, তাই এ খবর আমি আপনাকে বলছি, আপনার হয়তো কাজে লাগতে পারে-পাঁচ-ছে। মহিনে আগে দুজন লোক—তখনও মিঃ উপাধ্যায় ছিলেন। এখানে—একজন সিন্ধী কি মাড়োয়ারি হবে।–হি লুকড় এ রিচ ম্যান-অ্যান্ড অ্যানাদার ম্যান-দুজন উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। অনেক কথা হচ্ছিল সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম। এক ঘণ্টার উপর ছিল। তারা যাবার পর উপাধ্যায় একটা কথা আমাকে বলে–পণ্ডিতজী, আজ আমি একটি রিপুকে জয় করেছি। মিঃ সিংঘানিয়া আমাকে লোভের মধ্যে ফেলেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি সে লোভ কাটিয়ে উঠেছি।
আপনি উপাধ্যায়ের এই সম্পত্তির কথা আর কাউকে বলেননি?
দেখুন মিঃ মিত্তর, ওঁর যে একটা কিছু লুকোবার জিনিস আছে, সেটা অনেকেই জানত। আর সেই নিয়ে আড়ালে ঠাট্টাও করত। আমার আবার সন্ধাবেলায় একটু নেশা করার অভ্যাস আছে, হয়তো কখনও কিছু বলে ফেলেছি। কিন্তু উপাধ্যায়জীকে সকলে এখানে এত ভক্তি করত যে, সিন্দুকে কী আছে সেই নিয়ে কেউ কোনও দিন মাথা ঘামায়নি।
এই যে রুদ্রপ্ৰয়াগ গেলেন তিনি, এর পিছনে কোনও কারণ আছে?
আমাকে বলেছিলেন, গঙ্গার ঘাটে ওঁর একজন সাধুর সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁর সঙ্গে কথা বলে উপাধ্যায়ের মধ্যে একটা মানসিক চেঞ্জ আসে। আমার মনে হয়, চেঞ্জটা বেশ সিরিয়াস ছিল। কথা-টথা সব কমিয়ে দিয়েছিলেন। অনেক সময় চুপচাপ বসে ভাবতেন।
ওঁর ওষুধপত্তর কি উনি সঙ্গেই নিয়েছিলেন?
ওষুধ বলতে তো বেশি কিছু ছিল না; কয়েকটা বৈয়াম, কিছু শিকড়-বাকল, কিছু মলম, কিছু বড়ি—এই আর কী। এগুলো সবই উনি নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে আমার নিজের ধারণা উনি ক্ৰমে পুরোপুরি সন্ন্যাসের দিকে চলে যাবেন।
উনি বিয়ে করেননি?
না। সংসারের প্রতি ওঁর কোনও টান ছিল না। যাবার দিন আমাকে বলে গেলেন-ভোগের রাস্তা, ত্যাগের রাস্তা, দুটোই আমার সামনে ছিল। আমি ত্যাগটাই বেছে নিলাম।
ভাল কথা বলল ফেলুদা, আপনি যে বললেন, ওঁর রুদ্রপ্ৰয়াগের ঠিকানা আপনি দিয়ে দিয়েছেন ওই ভদ্রলোকটিকে-আপনি ঠিকানা পেলেন কী করে?
কেন, উপাধ্যায় আমাকে পোস্টকার্ড লিখেছে সেখান থেকে।
সে পোস্টকার্ড আছে?
আছে বইকী।
মিঃ পণ্ডিত তাঁর পিছনের একটা তাকে রাখা বাক্সের ভিতর হাত ঢুকিয়ে একটা পোস্টকার্ড বার করে ফেলুদাকে দিলেন। হিন্দিতে লেখা আট-দশ লাইনের চিঠি। সেটা ফেলুদা বার বার পড়ল কেন, আর পড়ে বিড়বিড় করে দু বার মোস্ট ইন্টারেস্টিং বলল কেন, সেটা বলতে পারব না।
মিঃ পণ্ডিত আমাদের একটা ভাল ট্যাক্সির কথা বলে দিলেন। আপাতত রুদ্রপ্ৰয়াগ, তার পর যেখানেই যাওয়া দরকার-সেখানেই যাবে। গাড়োয়ালি ড্রাইভারের নাম যোগীন্দরীরাম। লোকটিকে দেখে আমাদের ভাল লাগল। আমরা বললাম, বারোটা নাগাদ খেয়েদেয়ে রওনা দেব হৃষীকেশ থেকে। হৃষীকেশ। এখান থেকে মাইল পনেরো। হরিদ্ধারে কিছুই দেখবার নেই, গঙ্গার ঘাটটা পর্যন্ত আগের বার যা দেখেছিলাম, তেমন আর নেই। বিশ্ৰী দেখতে সব নতুন বাড়ি উঠেছে আর তাদের দেওয়াল-জোড়া বিজ্ঞাপন। হৃষীকেশে যাওয়া দরকার, কারণ আমাদের রুদ্রপ্ৰয়াগে থাকার বন্দোবস্ত করতে হবে। ইচ্ছে করলে ধরমশালায় থাকা যায়; এখানে প্রায় সব শহরেই বহু দিনের পুরনা নাম-করা কালীকমলী ধরমশালা রয়েছে, কিন্তু ফেলুদা জানে যে রূপনারায়ণগড়ের ছোটকুমার ও সব ধরমশালায় থাকবে না।
আমরা হৃষীকেশে গিয়ে গাড়ওয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের রেস্ট হাউসে একটা ডবল-রুম পেয়ে গেলাম। ওরা বলল যে, তিনজন লোক হলে বাড়তি একটা খাটিয়া পেতে দেবে। বারোটা নাগাদ খেয়ে আমরা রওনা দিলাম রুদ্রপ্ৰয়াগ। কয়েক মাইল যাবার পর ডাইনে পড়ল। লছমনঝুলা। এখানেও দুদিকে বিশ্ৰী বিশ্ৰী নতুন বাড়ি আর হোটেল হয়ে জায়গাটার মজাই নষ্ট করে দিয়েছে। তাও বাদশাহী আংটির শেষ পর্কের ঘটনা মনে করে গা-টা বেশ ছমছম করছিল।