বাদশাহী আংটির ক্লাইম্যাকস্-টা যে হরিদ্বারেই শুরু হয়েছিল, সেটা আমিও কোনও দিন ভুলব না।
পার্ক হোটেলে টেলিফোন করে কেসটা নিচ্ছে বলে ফেলুদা মিঃ পুরীকে জানিয়ে দিয়েছিল। আর মিঃ পুরীও আধা ঘণ্টার মধ্যে এসে আগাম টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুষ্পক ট্র্যাভেলাসে ফোন করে ফেলুদ। ডুন এক্সপ্রেসে আমাদের বুকিং-এর জন্য জানিয়ে দিয়েছিল। হঠাৎ দুদিন পরে এক অদ্ভুত ব্যাপার। রূপনারায়ণগড় থেকে মিঃ পুরীর এক টেলিগ্রাম এসে হাজির–
রিকেগয়েস্ট ড্রপ কেস। লেটার ফলোজ।
ড্রপ কেস! এ তো তাজ্জব ব্যাপার। এমন তো আমাদের অভিজ্ঞতায় কখনও হয়নি।
মিঃ পুরীর চিঠিও এসে গেল দু দিন পরে। মোদ্দা কথা হচ্ছে-ছোটকুমার মত পালটেছে। সে হরিদ্বার-হৃষীকেশ গিয়ে ছবি তুলবে, তাতে উপাধ্যায় থাকবেন, কিন্তু তাতে শুধু দেখানো হবে তিনি কীভাবে নিজের তৈরি ওষুধ দিয়ে স্থানীয় লোকের চিকিৎসা করেন। রূপনারায়ণগড়ের রাজার চিকিৎসাও যে উপাধ্যায় করেছিলেন, সেটা ছবিতে বলা হবে, কিন্তু মহামূল্য পারিতোষিকের কথাটা বলা হবে না।
ফেলুদা টেলিগ্রামে উত্তর দিল—ড্রপিং কেস, বাট গোইং অ্যাজ পিলগ্রিমস। অর্থাৎ কেস বাতিল করছি, কিন্তু তীর্থযাত্রী হিসেবে যাচ্ছি।
আমি জানি, ফেলুদা ও কথা লিখলেও ও নিজের গরজেই চোখ-কান খোলা রাখবে, আর তদন্তের কোনও কারণ দেখলে তদন্ত করবে! সত্যি বলতে কী, ভবানী উপাধ্যায় আর ছোটকুমার পবনদেও সিং-এই দুটি লোককেই আমার খুব ইণ্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছিল।
আমরা তিনজন এখন ডুন এক্সপ্রেসের একটা থ্রি টিয়ার কম্পার্টমেন্টে বসে আছি! ফৈজাবাদ স্টেশনে মিনিট দু-এক হল গাড়ি থেমেছে, আমরা ভাঁড়ের চা কিনে খাচ্ছি।
আপনি যে বলছিলেন। হরিদ্বার গেসলেন, সেটা কবে? ফেলুদা তার সামনের সিটে বসা লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করল।
আমার ঠাকুরদা একবার সপরিবারে তীর্থভ্রমণে যান, বললেন লালমোহনবাবু, ইনকুডিং হরিদ্বার; তখন আমার বয়সে দেড়; কাজেই নো মেমরি।
এবার অন্য দিক থেকে একটা প্রশ্ন এল।
আপনারা কি শুধু হরিদ্বারই যাচ্ছেন, না। ওখান থেকে এ দিকে ও দিকেও ঘুরবেন?
এ-প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবুর পাশে বসা এক বৃদ্ধ। মাথায় সামান চুল যা আছে তা সবই পাকা, কিন্তু চামড়া টান, দাঁত সব ওরিজিনাল, আর চোখের দুপাশে যে খাঁজগুলো রয়েছে, সেগুলো যেন হাসবার জন্য তৈরিই হয়ে আছে।
হরিদ্বারে একটু কাজ ছিল, বলল ফেলুদা। সেটা হয়ে গেলে পর.দেখা যাক–
কী বলছেন মশাই! বৃদ্ধের চোখ কপালে উঠে গেছে-অ্যাদাপূর এসে কেদার-বস্ত্রীটা দেখে যাবেন না? বন্দ্রীনাথ তো সোজা বাসে করেই যাওয়া যায়। কেদারের শেষের কাটা মাইল অবিশ্যি এখনও বাসা-রুটি হয়নি। তবে এও ঠিক যে কেদারের কাছে বস্ত্রী কিছুই নয়। যদি পারেন তো একবার কেদারটা ঘুরে আসবেন। শেষের হাঁটা পথটুকু আর– ফেলুদা আর আমার দিকে তাকিয়ে-আপনাদের বয়সে কী! আরি- লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে–এনার জন্য তো ডাণ্ডি আর টাটু ঘোড়াই আছে। টাটু ঘোড়ায় কখনও?
শেষের প্রশ্নটা অবিশ্যি লালমোহনবাবুকেই করা হল। লালমোহনবাবু হাতের ভাঁড়টায় একটা শেষ চুমুক দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে গম্ভীরভাবে অন্য দিকে চেয়ে বললেন, আজ্ঞে না, তবে থর ডেজার্টে একবার উটের পিঠে চড়ে দৌড়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেটা আপনার হয়েছে কি?
বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। —ত হয়নি। আমার চরবার ক্ষেত্র হল হিমালয়ের এই বিশেষ অংশ। তেইশবার এসেছি কেদার-বস্ত্রী। ভক্তি-টিক্তি আমার যে তেমন আছে তা নয়, তবে এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য থেকেই আমি সব আধ্যাত্মিক শক্তি আহরণ করি। কোনও বিগ্রহের দরকার হয় না।
ভদ্রলোকের নাম পরে জেনেছিলাম মাখনলাল মজুমদার। শুধু কেদার-বন্দ্রী নয়, যমুনেত্রী, গঙ্গোত্রী, গোমুখ, পঞ্চকেদার, বাসুর্কিতাল-এ সবও এঁর দেখা আছে। নেহাত একটা সংসার আছে, না হলে হিমালয়েই থেকে যেতেন। অবিশ্যি এটাও বললেন যে, আজকের বাস-ট্যাক্সিতে করে যাওয়া আর আগেকার দিনের পায়ে হেঁটে যাওয়া এক জিনিস নয়। বললেন, আজকাল তো আর কেউ পিলগ্রিম নয়, সব পিকনিকারস। তবে হ্যাঁ, গাডির রাস্তা তৈরি করে তো আর হিমালয়ের দৃশ্য পালটানো যায় না। নয়নাভিরাম বলতে যা বোঝায়, সে রকম দৃশ্য এখনও অফুরন্ত আছে।
ভোর ছটায় ডুন এক্সপ্রেস পৌঁছাল হরিদ্বার।
সেই বাদশাহী আংটির সময় যেমন দেখেছিলাম, পাণ্ডার উপদ্রবটা যেন তার চেয়ে একটু কম বলে মনে হল। স্টেশনেই একটা রেস্টোরান্টে চা-বিস্কুট খেয়ে নিলাম। উপাধ্যায়ের নাম এখানে অনেকেই জানে আন্দাজ করেই বোধহয় ফেলুদা রেস্টোরান্টের ম্যানেজারকে তাঁর হদিস জিজ্ঞেস করল।
উত্তর শুনে বেশ ভালরকম একটা হোঁচট খেলাম।
ভবানী উপাধ্যায় তিন-চার মাস হল হরিদ্বার ছেড়ে রুদ্রপ্রয়াগ চলে গেছেন।
তাঁর বিষয়ে আরও খবর কে দিতে পারে, বলতে পারেন? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা। উত্তর এল-এখনকার খবর পেতে হলে রুদ্রপ্ৰয়াগ যেতে হবে, আর যদি আগেকার খবর চান। তো কাস্তিভাই পণ্ডিতের কাছে যান। উনি ছিলেন উপাধ্যায়জীর বাড়িওয়ালা। তিনি সব খবর জানবেন।
তিনিও কি লক্ষ্মণ মহল্লাতেই থাকেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ। পাশাপাশি বাড়িতে থাকতেন ওঁরা। সবাই ওঁকে চেনে ওখানে। জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে।