আপনি তখনও ম্যানেজার?
আজ্ঞে হ্যাঁ; এবং আমি প্ৰাণপণে চেষ্টা করছি। যাতে ব্যবসা ইত্যাদির সাহায্যে রূপনারায়ণগড়ের ভবিষ্যৎকে আরও মজবুত করা যায়। কিন্তু মুশকিল হয়েছে কী, সূর্যদেও-এর এসব দিকে কোনও উৎসাহ নেই। তার নেশা হচ্ছে বই। সে দিনের মধ্যে ষোলো ঘণ্টা তার লাইব্রেরিতে পড়ে থাকে। সেখানে আমার একার চেষ্টায় আমি কী করতে পারি? ফলে আর্থিক দিক দিয়ে স্টেটের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়ে আসতে থাকে।
আপনার নিজের ছেলেও তো তত দিনে বড় হয়েছে?
হ্যাঁ। দেবীকে অবশ্য আমি আগেই আলিগড়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিই। সে আর রূপনারায়ণগড়ে ফেরেনি। দিল্পী গিয়ে নিজেই ব্যবসা শুরু করেছে।
আপনার কি ওই একই ছেলে?
আজ্ঞে হ্যাঁ। যাই হাক, আমার নিজের অনেকবার মনে হয়েছে যে ম্যানেজারি ছেড়ে দিয়ে আমার নিজের দেশ মোরাদাবাদে গিয়ে একটা কিছু করি, কিন্তু মায়া কাটাতে পারছিলাম না।
মিঃ পুরী এবার পকেট থেকে একটা চুরুট বার করে ধরিয়ে নিয়ে বললেন, এবার আমি আসল ঘটনায় আসছি; আপনার ধৈর্যচ্যুতি হয়ে থাকলে আমায় মাপ করবেন।
সাত দিন আগে, অর্থাৎ উনত্ৰিশে এপ্রিল, শনিবার রূপনারায়ণগড়ের ছেণ্টিকুমার পবনদেও সিং হঠাৎ আমার কাছে এসে হাজির হন। তার প্রথম কথাই হল, আমার বাবার হাঁপানি যিনি সারিয়েছিলেন, তাঁর নাম ও তাঁর হরিদ্বারের ঠিকানাটা আমার চাই।
স্বভাবতই আমি প্রথমে জিজ্ঞেস করলাম, কারুর কোনও অসুখ করেছে কি না। পবন বলল, না, তা নয়; সে একটা টেলিভিশনের ছবি করছে, তার জন্য তার এই ভদ্রলোককে দরকার।
পবন যে ক্যামেরা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে সেটা আমি জানতাম, কিন্তু সে যে টেলিভিশন নিয়ে মেতে উঠেছে, সে খবর জানতাম না। আমি বললাম, তুমি কি তোমার ছবিতে সে ভদ্রলোককে দেখাতে চাও? সে বললে, অবশ্যই। শুধু তাই না। বাবা তাকে যে লকেটটা দিয়েছিলেন সেটাও দেখাব। একটা অসুখ সারিয়ে এ রকম বিকশিস আর কেউ কোথাও পেয়েছে বলে আমার মনে হয় না।
তখন আমার পবনকে বলতেই হল যে, উপাধ্যায়। তাঁর এই পারিতোষিকের ব্যাপারটা একেবারেই প্রচার করতে চাননি। পবন বলল, ত্রিশ বছর আগে একটা লোক যে কথা বলেছে, আজও যে সে তাই বলবে এমন কোনও কথা নেই। সমস্ত পৃথিবীর কাছে নানা রকম তথ্য পরিবেশন করা টেলিভিশনের একটা প্রধান কাজ। আপনি আমাকে নাম ঠিকানা দিন; ওঁকে রাজি করবার ভার আমার।
কী আর করি; বাধ্য হয়ে উপাধ্যায়ের নাম ঠিকানা দিয়ে দিলাম; সে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল।
উপাধ্যায়ের বয়স এখন আন্দাজ কত হবে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
তা সত্তর-বাহাত্তর তো হবেই। রূপনারায়ণগড়ে যখন এসেছিল, তখন তার যৌবন পেরিয়ে গেছে।
ফেলুদা উমাশঙ্করের দিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, আপনি কি শুধু এই ব্যাপারটার গোপনীয়তা রক্ষা হবে না বলেই চিন্তিত হচ্ছেন?
মিঃ পুরী মাথা নাড়লেন।
না মিঃ মিটার। আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছেন। শুধু যদি তাই হত, তা হলে আমি আপনার কাছে আসতাম না। আমার ভয় হচ্ছে ওই লকেটটাকে নিয়ে। পবনের নতুন শখ হয়েছে। টেলিভিশনের ছবি তোলার। আপনি নিশ্চয় জানেন যে কাজটা খরচসাপেক্ষ। পবনের নিজের কোনও অর্থ সংগ্রহের রাস্তা আছে কিনা জানি না, কিন্তু এটা জানি যে, ওই একটি লকেট ওর সমস্ত অর্থসমস্যা দূর করে দিতে পারে।
কিন্তু ওই লকেটটি হাত করতে হলে তো তাকে অসদুপায় অবলম্বন করতে হতে পারে।
তা তো বটেই।
পবনদেও ছেলে কেমন?
সে বাপের কিছু দাষ-গুণ দুটোই পেয়েছে। পবনের মধ্যেও একটা বেপরোয়া দিক আছে। ভাল খেলোয়াড়। ছবি ভাল তোলে। আবার জুয়ার নেশাও আছে। অথচ তার দরাজ মনের পরিচয় পেয়েছি। ওকে চেনা ভারী শক্ত। যেমন ছিল ওর বাপকে।
তা হলে আপনি আমার কাছে কী চাইছেন?
আমি চাইছি, আপনি দেখুন যাতে এই অসদুপায়টি অবলম্বন না করা হয়।
পবনদেও কি হরিদ্বার যাচ্ছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ, তবে তাঁর যেতে একটু দেরি হবে—অন্তত পাঁচ-সাত দিন, কারণ এখন উনি প্যালেসের ছবি তুলছেন।
আমাদেরও যেতে গেলে সময় লাগবে, কারণ তার আগে তো ট্রেনে বুকিং পাওয়া যাবে না।
তা বটে।
কিন্তু ধরুন যদি আমি কেসটা নিই, আমি আপনাদের ছাট কুমারকে চিনছি কী করে?
সে ব্যবস্থাও আমি করে এনেছি। দিল্লির একটি সাপ্তাহিক কাগজে কুমারের এই রঙিন ছবিটা বেরিয়েছিল গত মাসে। একটা বিলিয়ার্ড চ্যামপিয়নশিপে জিতেছিল। এটা আপনি রাখুন। আর ইয়ে, আপনাকে আগাম কিছু…?
আমি হাজার টাকা অ্যাডভান্স নিই, বলল ফেলুদা।কেস সফল না হলেও সেটা ফেরত দিই না, কারণ সফল না হওয়াটা অনেক সময় গোয়েন্দার অক্ষমতার উপর নির্ভর করে না। সফল হলে আমি আরও এক হাজার টাকা নিই।
বেশ। আপনাকে এখনই কিছু বলতে হবে না। আমি পার্ক হোটেলে আছি। আপনি কী স্থির করেন, বিকেল চারটে নাগাত ফোন করে জানিয়ে দেবেন। হ্যাঁ হলে আমি নিজে এসে আপনাকে আগাম টাকা দিয়ে যাব।
০২. মাইক্রোক্যাসেট রেকর্ডার
ফেলুদা যে কেসটা নেবে, সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। আজকাল আমরা মক্কেলের কথাবার্তা হংকং থেকে কেনা একটা মাইক্রোক্যাসেট রেকর্ডারে তুলে রাখি। মিঃ পুরীর বেলাতে ওঁর অনুমতি নিয়ে তাই করেছিলাম। ফেলুদা দুপুরে সেই সব কথাবার্তা প্লে ব্যাক করে খুব মন দিয়ে শুনে বলল, কেসটা নেবার সপক্ষে দুটো যুক্তি রয়েছে; একটা হল এর অভিনবত্ব, আর দুই হল-গোয়েন্দাগিরির প্রথম যুগে দেখা হরিদ্বার-হৃষীকেশটা আর একবার দেখার লোভ।