যাক্ গে—এবার বলুন আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি।
মিঃ পুরী গভীর হয়ে নিজেকে সংযত করে নিলেন। তার পর বললেন, মিঃ মিটার, আমি থাকি ভারতবর্ষের আরেক প্রান্তে। আপনার নাম আমি শুনেছি। ভগওয়ানগড়ের রাজার কাছ থেকে। শুধু নাম নয়, প্রশংসা। তাই আমি আপনার কাছে এসেছি।
আমি তাতে গর্ব বোধ করছি।
এখন কথা হচ্ছে কি— মিঃ পুরী থামলেন। তাঁর মধ্যে একটা ইতস্তত ভাব লক্ষ করছিলাম। তিনি আবার বললেন, ব্যাপারটা হচ্ছে কি—একটা দুর্ঘটনা ঘটতে পারে; সেইটে যাতে না ঘটে তাই আমি আপনার সাহায্য চাইছি। সেটা পাওয়া যাবে কি?
ফেলুদা বলল, আপনি কী ঘটনা বা দুর্ঘটনার কথা বলছেন, সেটা না জানা পর্যন্ত আমি মতামত দিতে পারছি না।
শ্ৰীনাথ এই সময় চা-চানাচুর-বিস্কুট এনে রাখাতে কথায় একটু বিরতি পড়ল। তারপর মিঃ পুরী একটা বিস্কুট তুলে নিয়ে বললেন, আপনি রূপনারায়ণগড় স্টেটের নাম শুনেছেন?
নামটা চেনা-চেনা লাগছে, বলল ফেলুদা, উত্তরপ্রদেশে কি?
ঠিকই বলেছেন, বললেন মিঃ পুরী।আলিগড় থেকে ৯০ কিলোমিটার পশ্চিমে। আমি যখনকার কথা বলতে যাচ্ছি সেটা আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে। তখন রাজা ছিলেন চন্দ্ৰদেও সিং। আমি ছিলাম এস্টেটের ম্যানেজার। ভারত স্বাধীন হয়ে গেলেও তখনও এসব নেটিভ স্টেটের উপর তত চাপ পড়েনি; রাজার রাজাই ছিলেন। চন্দ্ৰদেও-এর বছর চুয়ান্ন বয়স, কিন্তু তখনও সিংহের মতো চেহারা। শিকার করেন, টেনিস খেলেন, পোলো খেলেন, প্রৌঢ়ত্বের কোনও লক্ষণ নেই। একটি ব্যারাম তাঁকে মাঝে মাঝে বিব্রত করত, কিন্তু সেটা যে হঠাৎ এমন আকার ধারণ করবে, সেটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। হাঁপানি। সে যে কী হাঁপানি সে আমি আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। একটা জলজ্যান্ত জোয়ান মানুষকে ছ’ মাসের মধ্যে কঙ্কালে পরিণত হতে এই প্রথম দেখলাম। কোনও ওষুধে কোনও কাজ দিল না। হয়তো দু দিন দেয়, আবার যেই কে সেই!
সেই সময় খবর এল, হরিদ্বারে নাকি এক ভদ্রলোক থাকেন, নাম ভবানী উপাধ্যায়, তিনি নাকি হাঁপানির অব্যর্থ ওষুধ জানেন। বহু রুগি তাঁর ওষুধে সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভ করেছে।
আমি নিজেই চলে গেলাম হরিদ্বার। ঠিকানা জানা ছিল না ভদ্রলোকের, কিন্তু খোঁজ পেতে অসুবিধা হল না, কারণ ওঁকে অনেকেই চেনে। সাদাসিধা মানুষ, ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকেন, আমাকে যথেষ্ট খাতির করে তাঁর তক্তপোশে বসলেন। তার পর সব শুনেটুনে বললেন, আমি যাব আপনার সঙ্গে, রাজাকে ওষুধ দেব; সারবার হলে দশ দিনের মধ্যে সারবে, না হলে নয়। সেই দশ দিন আমি ওখানে থাকব। ওষুধে কাজ না দিলে আমি কোনও পয়সা নেব না।
বললে বিশ্বাস করবেন না। মিঃ মিটার, দশ দিন নয়, সাত দিন নয়, তিন দিনের মধ্যে রাজার হাঁপানি উধাও। এমন যে ঘটতে পারে সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। উপাধ্যায় বললেন তাঁর ওষুধের দাম পঞ্চাশ টাকা। রাজাকে বলতে তিনি তো কথাটা কানেই তুললেন না। বললেন, আমি মরতে বসেছিলাম, উনি এসে আমাকে নতুন জীবন দান করলেন, আর তার দাম হল। কিনা পঞ্চাশ টাকা?
এখানে বলে রাখি যে রাজা চন্দ্ৰদেও মানুষটা একটু খামখেয়ালি ছিলেন। তা ছাড়া তাঁর শোক, তাঁর আনন্দ, তাঁর ক্ৰোধ, তাঁর দয়া-দক্ষিণ্য-সবই সাধারণ মানুষের চেয়ে মাত্রায় অনেকটা বেশি ছিল। পঞ্চাশ টাকার বদলে উনি উপাধ্যায়কে যেটা দিলেন, সেটা একটা মণিমুক্তাখচিত সোনার বালগোপাল। জিনিসটা আসলে একটা পেনডোন্ট বা লকেট-ল স্বায় ইঞ্চি তিনেক। তখনকার দিনে সেটার দাম পাঁচ-সাত লাখ টাকা।
একটু ফাঁক পেয়ে ফেলুদা প্রশ্ন করল, উপাধ্যায় নিলেন সেই লকেট?
সেই কথাই তো বলছি, বললেন উমাশঙ্কর পুরী। উপাধ্যায় বললেন, আমি সাদাসিধে। মানুষ, আমাকে এমন বিপাকে ফেলছেন কেন? এত দামি একটা জিনিস আমার কাছে থাকবে, সেটা লোকে আমার বলে বিশ্বাস করবে। কেন? সবাই ভাববে। আমি চুরি করেছি।
রাজা বললেন—কারুর তো জানার দরকার নেই। আমরা তো আর খবরটা ঢাকা পিটিয়ে জাহির করতে যাচ্ছি না। আর নেহাতই যদি কেউ জেনে ফেলে, তার জন্য আমি আমার নিজের সিলমোহর দিয়ে লিখে দিচ্ছি যে, এটা আমি তোমাকে পারিতোষিক হিসেবে দিলাম। এর পরে তো আর কারুর কিছু বলার নেই।
উপাধ্যায় বলল, তাই যদি হয়, তা হলে আমি মাথা পেতে নেবা আপনার এ পারিতোষিক।
ফেলুদা বলল, আপনি, রাজা, এবং উপাধ্যায়—এই তিনজন ছাড়া আর কেউ কি ঘটনাটা জানত?
আমি সত্যি কথা বলব, বললেন উমাশঙ্কর পুরী, রাজা নিজে যদি খেয়ালবশে কাউকে বলে থাকেন তো সে আমি জানি না; ব্যাপারটা জানত রাজা, রানি এবং দুই রাজকুমার-সূর্য ও পবন। বড় কুমার সূর্যয অতি চমৎকার ছেলে, রাজপরিবারে এমন দেখা যায় না। তার বয়স তখন বাইশ-তেইশ। ছোট কুমারের বয়স পনেরো। এ ছাড়া জানতাম আমি, আমার স্ত্রী আর আমার ছেলে দেবীশঙ্কর—তার বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। ব্যস, আর কেউ না। আর এটাও আপনি খেয়াল করে দেখুন। মিঃ মিটার—এ খবর কিন্তু গত ত্রিশ বছরে কোনও কাগজে বেরোয়নি। আপনি তো সাংবাদিকদের জানেন; তারা এর গন্ধ পেলে কি ছেড়ে দিত?
সে কথা ঠিক, বলল ফেলুদা, ব্যাপারটার গোপনীয়তা রক্ষিত হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
যাই হাক, এবার আমি এগিয়ে আসছি। বর্তমানের দিকে। রাজা চন্দ্ৰদেও সিং বেঁচেছিলেন আর বছর বারো। তার পর সূর্যদেও রাজা হলেন। রাজা মানে, তখন তো আর রাজা কথাটা ব্যবহার করা চলে না; বলতে পারেন। উনিই হলেন কর্তা।