অস্ত্রটা আর কিছুই না, গৌরীকুণ্ডে দুটাকা দিয়ে কেনা সেই লোহা-লাগানো লাঠি। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, লোকটার মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে কিন্তু সেই অবস্থাতেই সে আবার উঠে, এক দৌড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল!
এদিকে ফেলুদা উঠে বসেছে। বাঝাই যাচ্ছে সে বেশ কারু। আমরা দু জন দু দিক থেকে তাকে ধরে তুললাম। আমাদের ধরমশালায় প্রায় পৌঁছে গেছি। শেষ পথটুকু ফেলুদা শুধু একটা কথাই বলল, কেদারেও তাহলে গুণ্ড এসে পৌঁছে গেছে!
কপাল-জোরে আমাদের পাশের ঘরেই একজন বাঙালি ডাক্তার পাওয়া গেল, নাম অধীর সেন। অধীরবাবু আবার ফেলুদাকে চিনে ফেললেন, কাজেই যত না জখম, তার তুলনায় শুশ্রুষাটা একটু বেশিই হল। ডান কাঁধে একটা জায়গায় কেটে গিয়েছিল, সেখানে ওষুধ দিয়ে ব্যান্ড-এন্ড দিয়ে দিলেন। বললেন, ফ্র্যাকচার হয়েছে কি না, সেটা তো এক্স-রে না করলে বোঝা যাবে না!
ফেলুদা বলল, ফ্র্যিাকচারই হোক আর যাই হাক, আমাকে বিছানায় শুইয়ে রাখতে পারবেন না, এটা আগে থেকেই বলে দিলাম।
ফি-এর কথা জিজ্ঞেস করাতে ভদ্রলোক জিভ-টিভ কেটে একাক্কার-তবে ব্যাপারটা কী জানেন, মিঃ মিত্তির। এই নিয়ে আমার তিনবার হল কেদার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন ছিল তেমনই আছে, কিন্তু ক্ৰমে অ্যান্টি-সোশ্যাল এলিমেণ্টস ঢুকে পড়ছে। শহরে। এর জন্য দায়ী কী জানেন তো? আমাদের যানবাহনের সুব্যবস্থা। এক দিকে ভাল করেন তো অন্য দিক দিয়ে খারাপ ঢুকে পড়ে–এই তো দেখে আসছি জগতের নিয়ম।
কালীকমলীর ম্যানেজার নিজের বুদ্ধি খাটিয়েই এখানকার পুলিশকে খবর দিয়ে আনিয়ে নিয়েছিলেন। ফেলুদা তার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথা বলল। বুঝতে পারলাম যে, নানা রকম নির্দেশ দেওয়া হল, এবং সবই দারোগা সাহেব অতি মনোযোগের সঙ্গে শুনে নিলেন।
পুলিশ চলে যাবার পর সাংবাদিক মিঃ ভার্গব এসে হাজির-শুনলাম আপনার লাইফের উপর একটা অ্যাটেম্পট হয়ে গেছে?
গোয়েন্দার জীবনে এ তো দৈনন্দিন ঘটনা, মিঃ। ভার্গব। এখানকারই কোনও গুণ্ডা হয়তো পকেট মারতে চেয়েছিল, কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি।
আপনি বলতে চান, আপনার কোনও তদন্তের সঙ্গে এর কোনও কানেকশন নেই?
তদন্ত আবার কোথায়? আমি তো এখানে এসেছি উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে।
ভাল কথা, তিনি কোথায় থাকেন সে খবর পেয়েছেন?
আপনি পেয়েছেন?
উপাধ্যায় বলে এখানে কেউ কাউকে চেনে না।
তা হলে ভদ্রলোক হয়তো নাম বদলেছেন।
তাই হবে।
ফেলুদা আসল ব্যাপারটা বেমালুম চেপে গেল। ভার্গব কিছুটা নিরাশ হয়েই যেন চলে গেলেন।
কাল সকাল সকাল উঠতে হবে বলে আমরা সাড়ে আটটার মধ্যে পুরি-তরকারি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ার আয়োজন করতে লাগলাম। এই সময় ফেলুদা যে ব্যাপারটা করল, সেটা কিন্তু আমি আর লালমোহনবাবু মোটেই অ্যাপ্রভ করতে পারলাম না। ও বলল, তোরা দুজনে শুয়ে পড়, আমি একটু ঘুরে আসছি।
ঘুরে আসছি মানে? আমি অবাক এবং কিছুটা বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম। আমি জানি, ওর কাঁধে এখনও বেশ ব্যথা। কোত্থেকে ঘুরে আসছ?
একবার ছোটকুমারের সঙ্গে দেখা করা দরকার।
সে কী, তুমি সোজা এনিমি ক্যাম্পে চলে যাবে?
আমার এ রকম অনেক বার হয়েছে রে তোপ্সে। একটা চাট খেয়ে বুদ্ধিটা খুলে গেছে। এবারও তাই। পবনদেও আমাদের শত্রু না।
তবে?
আসল শত্ৰু কে, সেটা জানতে পারবি খুব শিগগিরই।
কিন্তু তুমি বেরোবে, আর শক্ৰ যদি এখন ওঁত পেতে থাকে?
আমার সঙ্গে অস্ত্ৰ আছে। তোরা শুয়ে পড়ে। আমি যখনই ফিরি না কেন, কালকের প্রোগ্রামে কোনও চেঞ্জ নেই। গান্ধী সরোবর। ভোর সাড়ে চারটায় রওনা হচ্ছি।
সঙ্গে রিভলভার আর একটা বড় টর্চ নিয়ে ফেলুদা চলে গেল।
তোমার দাদার সাহসের জবাব নেই, বললেন জটায়ু।
০৮. ফেলুদা কাল রাত্তিরে কখন ফিরেছে
ফেলুদা কাল রাত্তিরে কখন ফিরেছে জানি না। সেটা ওকে আর জিজ্ঞেস করলাম না, কারণ ও দেখলাম সাড়ে চারটার মধ্যে রেডি হয়ে আছে।
আমরা দুজনও দশ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নেওয়ার পর তিনজনে এক সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে এখন ফিকে ভোরের আলো, রাস্তার বাতিগুলো এখনও টিমটিম করে জ্বলছে।
কেদারনাথের মন্দির ছাড়িয়ে খোলা জায়গায় পড়ে ফেলুদা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তুই যে জিভ আর দাঁতের ফাঁক দিয়ে খুব জোরে শিস দিতিস, সেটা এখনও পারিস?
আমি একটু অবাক হয়েই বললাম, হ্যাঁ, তা পারি বইকী।
ফেলুদা বলল, আমি যখন বলব, তখন দিবি।
আমরা তিনজনেই সঙ্গে লোহার স্পাইক-দেওয়া লাঠি এনেছিলাম, তা না হলে মাঝে মাঝে বরফে ঢাকা এই পাথুরে পথ দিয়ে হাঁটা অসম্ভব হত। গোড়াতেই মন্দাকিনীর উপর দিয়ে একটা তক্তা-ফেলা সেতু পার হতে হয়েছে আমাদের। নদী এখানে সরু নালার মতো। তিন দিকে ঘিরে যে সব তুষার-শৃঙ্গ রয়েছে, তার কোনওটার নাম এখনও জানা হয়নি। তাদের মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে উঁচু, তার চূড়োয় গোলাপি আভা লক্ষ করা যাচ্ছে। শীত প্রচণ্ড, তারই মধ্যে কাঁপা গলায় লালমোহনবাবু হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, তো-হা-হাপসে তো শি-হিস দেবে; আমার ভূ-হূ-হূমিকাটা—?
ফেলুদা বলল, আপনি আপনার ওই হাতের লাঠিটা প্রয়োজনে পাগলা জগাই-এর মতো মাথার ওপর ঘোরাবেন, তাতে আপনার বীরত্ব আর ব্যারাম দুটোই একসঙ্গে প্রমাণ হবে।
বু-হু-ঝেছি।
আরও আধঘণ্টা চলার পরে দেখতে পেলাম, দূরে একটা ছাই রঙের মসৃণ সমতল প্রান্তর রয়েছে। চারিদিকের পাথরের মধ্যে সেটাই যে চোরাবালিতাল বা গান্ধী সরোবর, সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। তবু আমি ফেলুদার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ওটাই কি–? ফেলুদা ঘাড় নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল, হ্যাঁ।