কার কথা বলছেন, বলুন তো?
ভবানী উপাধ্যায় বলে এক ভদ্রলোক।
মাখনবাবুর চোখ কপালে উঠে গেল।
ভবানী? ভবানীর খোঁজ করছেন। আপনার? আর সে কথা অ্যাদ্দিন আমাকে বলেননি?
আপনি তাঁকে চেনেন নাকি?
চিনি মানে? সাত বিচ্ছর থেকে চিনি। আমার পেটের আলসার সারিয়ে দিয়েছিল এক বড়িতে। তার পর হরিদ্ধার ছাড়ার কিছু দিন আগেও আমার সঙ্গে দেখা করেছে! একটা বৈরাগ্য লক্ষ করেছিলাম ওর মধ্যে। বললে, রুদ্রপ্ৰয়াগে যাবে। আমি বললাম, বাসরুট হয়ে প্রয়াগ আর এখন সে জিনিস নেই। তুমি জপ তপ করতে চাও তো সোজা কেদার চলে যাও। বোধহয় একটা দেটিানার মধ্যে পড়েছিল, তাই কিছু দিন রুদ্রপ্ৰয়াগে থেকে যায়। কিন্তু এখন সে এখানেই।
সে তো বুঝলাম, কিন্তু কোথায়?
শহরের মধ্যে তাকে পাবেন না ভাই। সে এখন গুহাবাসী। চোরাবালিতাল নাম শুনেছেন? যাকে এখন গান্ধী সরোবর বলা হয়?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনেছি বটে।
ওই চোরাবালিতাল থেকে মন্দাকিনী নদীর উৎপত্তি। কেদারনাথের পিছন দিয়ে পাথর আর বরফের উপর দিয়ে মাইল তিনেক যেতে হবে। হ্রদের ধারে একটা গুহায় বাস করে ভবানী। উপাধ্যায় অংশটা তার নাম থেকে উবে গেছে; এখন সে ভবানীবাবা। এক থাকে, কাছেপিঠে আর কেউ থাকে না। কাল সকালে আপনার চেষ্টা করে দেখতে পাবেন।
আপনার সঙ্গে এবার দেখা হয়েছে?
না, তবে স্থানীয় লোকের কাছে খবর পেয়েছি। ফলমূলের জন্য তাকে বাজারে আসতে হয় মাঝে মাঝে।
আপনি আমাদের অশেষ উপকার করলেন, মিঃ মজুমদার। কিন্তু তাঁর অতীতের ইতিহাস কি এখানে কেউ জানে?
তা তো জানতেই পারে, বললেন মাখনবাবু, কারণ সে তো চিকিৎসা এখনও সম্পূর্ণ ছাড়েনি। এই কেদারনাথের মোহান্তই তো বলছিলেন যে, ভবানী সম্প্রতি নাকি একটি ছেলের পোলিও সরিয়ে দিয়েছে। তবে আমার ধারণা, সে কিছু দিনের মধ্যে আর চিকিৎসা করবে না–পুরোপরি সন্ন্যাসী বনে যাবে।
একটা শেষ প্রশ্ন, বলল ফেলুদা, ভদ্রলোক কোন দেশি তা আপনি জানেন?
এ বিষয় তো তাকে কোনও দিন জিজ্ঞেস করিনি। তবে সে আমার সঙ্গে সব সময় হিন্দিতেই কথা বলেছে। ভাল হিন্দি। তাতে অন্য কোনও প্রদেশের ছাপ পাইনি কখনও।
মাখনবাবু চলে গেলেন।
লালমোহনবাবু ইতিমধ্যে আমাদের দল থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন। এবার এগিয়ে এসে বললেন, বিড়লা গেস্ট হাউস থেকে আমাদের তলব পড়েছে।
কে ডাকছে? প্রশ্ন করল ফেলুদা।
একজন বেঁটে ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, মিঃ সিংঘানিয়া।
ফেলুদার ভুরুটা কুঁচকে গেল! আমাদের দিকে ফিরে চাপা গলায় বলল, মনে হচ্ছে এই সিংঘানিয়াই এক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে হরিদ্বার গিয়েছিলেন উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে। আমার মনে হয়, একে খানিকটা সময় দেওয়া যেতে পারে-চলিয়ে।
যদিও চারিদিকে অনেকগুলো বরফের পাহাড়ের চূড়োতে এখনও রোদ রয়েছে।–তার কোনওটা সোনালি, কোনওটা লাল, কোনওটা গোলাপি-কেদার শহরের উপর অন্ধকার নেমে এসেছে।
বিড়লা গেস্ট হাউস কেদারনাথের মন্দিরের পাশেই কাজেই আমরা তিন মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। দেখে মনে হল, এখানে হয়তো এটাই থাকবার সবচেয়ে ভাল জায়গা। অন্তত পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে তো বটেই; খাবারের কথা জানি না। খাবারের ব্যাপারে। এমনিতেও শুনছি, এখানে আলু ছাড়া আর বিশেষ কিছুই পাওয়া যায় না।
বেঁটে লোকটা আমাদের আগে আগে পথ দেখিয়ে বিড়লা গেস্ট হাউসের দোতলার একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে হাজির করল। বেশ বড় ঘর, চারিদিকে চারটে গদি পাতা। মাথার উপর একটা ঝুলন্ত লোহার ডাণ্ডা থেকে বেরোনো তিনটি হুকে টিমটিম করে তিনটে বালব। জ্বলছে। কেদারনাথে ইলেকট্রিসিটি আছে বটে, কিন্তু আলোর কোনও তেজ নেই।
আমরা মিনিটখানেক অপেক্ষা করতেই, যিনি আমাদের আহ্বান করেছিলেন, তাঁর আবির্ভাব হল।
০৭. মাই নেম ইজ সিংঘানিয়া
যা ভাবা যায়, সেটা যখন না হয়–তখন মনের অবস্থাটা আবার স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। সিংঘানিয়ার নামটার সঙ্গে সিংহের মিল আছে বলে বোধহয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কাউকে আশা করেছিলাম। যিনি এলেন তাঁর মাঝারি গড়ন, মেজাজে মাঝারি গাম্ভীৰ্য্য, গলার স্বর সরুও নয় মোটাও নয়। শুধু একটা মোটা পাকানো গোঁফে বলা যায় কিছুটা ভারিক্কি ভাব এসেছে।
মাই নেম ইজ সিংঘানিয়া বললেন ভদ্রলোক–প্লিজ সিট ডাউন।
আমরা তিনজনে দুটো গদিতে ভাগাভাগি করে বসলাম, সিংঘানিয়া বসলেন তৃতীয় গদিতে সোজা আমাদের দিকে মুখ করে। কথা হল ইংরেজি-হিন্দি মিশিয়ে।
সিংঘানিয়া বললেন, আপনার খ্যাতির সঙ্গে আমি পরিচিত মিঃ মিটার, কিন্তু আলাপ হবার সৌভাগ্য হয়নি।
ফেলুদা বলল, বিপদে না পড়লে তো আর আমার ডাক পড়ে না, তাই আলাপ হবার সুযোগও হয় না।
আমি অবিশ্যি আপনাকে বিপদে পড়ে ডাকিনি।
তা জানি, বলল ফেলুদা।আপনার নামও কিন্তু আমি শুনেছি। অবিশ্যি সিংঘানিয়া তো অনেক আছে, কাজেই যাঁর নাম শুনেছি, তিনিই আপনি কিনা বলতে পারব না।
আই অ্যাম ভেরি ইন্টারেস্টেড টু নো, আপনি কী ভাবে আমার নাম শুনলেন।
আপনি হরিদ্বার গিয়েছিলেন কখনও?
সার্টেনলি।
সেখানে ভবানী উপাধ্যায় বলে একজনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন?
করেছিলাম। বাইকী; কিন্তু আপনি সেটা জানলেন কী করে?
উপাধ্যায়ের বাড়িওয়ালা আমাকে বলেছিলেন যে, মিঃ সিংঘানিয়া এবং আর একজন ভদ্রলোক উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।