কই, দেখি।
এক পাতার চিঠিটা পড়ে বাবাও বললেন, বোঝো।
মা ততক্ষণে মোড়ায় বসে পড়েছেন।
একটা খটকা লেগেছে দুজনেরই সেটা বেশ বুঝতে পারছে মন্টু। বাবাই প্রশ্নটা করলেন।
আমাদের ঠিকানা পেলেন কোথায় বলো তো? আর ওঁর ভাগনির সঙ্গে যে সুরেশ বোস বলে একজনের বিয়ে হয়েছে, আর তারা যে এই মামুদপুরে থাকে সেটাই বা জানলেন কী করে?
মা একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে থেকে বললেন, শেতলমামা আছেন তো। তাঁর কাছেই জেনেছেন হয়তো।
শেতলমামা?
আঃ, তোমার আবার কিছু মনে থাকে না। মামাদের পড়শি ছিলেন নীলকণ্ঠপুরে। কত যাতায়াত ছিল আমাদের বাড়িতে। তুমিও তো দেখেছ। বাজি ফেলে ছাপান্নটা রাজভোগ খেলেন আমাদের বিয়েতে, সেই নিয়ে কত হাসাহাসি।
ও হ্যাঁ হ্যাঁ।
ছোটমামার সঙ্গে তো খুব মিতালি ছিল। গোড়ার দিকে মামা যে চিঠি দিতেন সে তো শুনেছি শেতলমামাকেই।
এ বাড়িতেও তো এসেছেন না শীতলবাবু?
বাঃ, আসেননি? রাণুর বিয়েতেই তো এলেন।
ঠিক ঠিক। কিন্তু তোমার ছোটমামা তো শুনেছিলাম সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন।
তাই তো জানতাম। তিনি আবার হঠাৎ আমার এখানে আসছেন কেন সেটা তো বুঝলাম না।
বাবা একটু ভেবে বললেন, অবিশ্যি আসতেই যদি হয়তো তোমার কাছে ছাড়া আর কার কাছে আসবেন বলো। তোমার বাপ মা বড় মামা বড় মামী সব পরলোকে। বড় মামার ছেলে কানাডা, মেয়ে সিঙ্গাপুর। তুমি ছাড়া তার আর আছে কে?
তা তো বুঝলাম, কিন্তু যে লোকটাকে প্রায় চোখেই দেখিনি তাকে মামা বলে চিনব কী করে? মামা যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যান তখন আমার বয়স দু বছর, আর ওনার ষোলো কি সতেরো।
ওঁর ছবি একখানা আছে না তোমার সেই পুরনো অ্যালবামে? তোমার যা কথা! সে চেহারা আর এখনকার চেহারা! তখন মামার বয়স পনেরো আর এখন ষাট।
সত্যি, খুব মুশকিলে পড়া গেল।
ঘর তো একখানা বাড়তি আছেই, বিনুর ঘর। কিন্তু কী খায় না খায় কিছু জানা নেই…
খাবে আবার কী? আমরা যা খাব তাই খাবে!
আমরা যা খাব মানে কী? যদি সাধু হয়ে থাকে তা হলে তো নিরামিষ খাবে। সে তো আরও ঝক্কি। পাঁচ রকম পদের কমে হবে না তার।
চিঠির ভাষা দেখে তো সাধু বলে মনে হয় না। দিব্যি আমাদেরই মতো লেখা। ইংরিজিতে তারিখ লিখেছে, ইংরিজি কথা ব্যবহার করেছে। এই তো–আনেসেসারি।
নিজের ঠিকানা তো দেয়নি।
তা দেয়নি।
আর সোমবারই আসছেন বলে লিখেছেন।
মা-বাবা দুজনেই খুব ভাবনায় পড়েছেন বলে মনে হল মন্টুর। সত্যি, যে মামাকে কেউ কোনওদিন চোখেই দেখেনি তাকে তো মামা বলে মনে করাই মুশকিল।
মন্টু এই দাদুর কথা বড় জোর একবার কি দুবার শুনেছে। ইস্কুলে পড়া শেষ হবার আগেই দাদু বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তারপর এই পঁয়তাল্লিশ বছরের গোড়ার কয়েকটা বছরের পর তার আর কোনও খবর পাওয়া যায়নি। মা বলতেন তিনি নিশ্চয়ই মরে গেছেন। মন্টুর দু-একবার মনে হয়েছে দাদু যদি হঠাৎ একদিন ফিরে আসেন তা হলে বেশ হয়। কিন্তু তারপরই মনে হয়েছে–সেরকম কেবল গল্পেই শোনা যায়। তাও গল্পে ঘর-পালানো লোক অনেকদিন পরে ফিরে এলে তাকে চেনবার লোক থাকে। এখানে তাও নেই। দাদু এল কি দাদু সেজে অন্য লোক এল তাও বলার জো নেই।
দাদু অবিশ্যি লিখেছেন বেশিদিন থাকবেন না–দিন দশেক। বাংলাদেশের ছোট মফঃস্বল শহরেই দাদুর ছেলেবেলা কেটেছে। সেই বাংলাদেশ দেখার ইচ্ছে হয়েছে দাদুর। নিজের দেশ নীলকণ্ঠপুরে তো যাওয়া যায় না, কারণ এখন আর সেখানে কেউ নেই। তাই মামুদপুরেই আসতে চান। তাও এখানে একজন ভাগনি আছে তো। মন্টুর বাবা এখানে ওকালতি করেন। মন্টুর দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, সে থাকে রিশড়ায়। দাদা কানপুরে হস্টেলে থেকে পড়ে আই আই টিতে।
রবিবারের মধ্যে মা সব ব্যবস্থা করে ফেললেন। দোতলার পশ্চিমের ঘরের খাটে নতুন বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, দাদুর জন্য সাবান ভোয়ালে গামছা, সবই এসে গেল। ট্রেন আসবে সকালে, দাদু নিজেই সুরেশ বোসের বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করে সাইকেল রিকশা নিয়ে চলে আসবেন। তারপর যা থাকে কপালে। বাবা আজই সকালে বলেছেন, মামা হোক আর না হোক, লোকটা যদি সভ্যভব্য মিশুকে হয় তা হলে একরকম চলে যাবে। না হলে এই দশটা দিন হুজ্জতের একশেষ।
ভাল্লাগেনা বাপু, বললেন মা, সাপ না ব্যাঙ না বিচ্ছু কিছু জানা নেই, এখন সামলাও ঝক্কি। ঠিকানাও দিল না লোকটা; তা হলে না হয় কোনও একটা ছুতোয় না করে দেওয়া যেত। এ যেন একেবারে পণ করে ঘাড়ে এসে চাপা।
মন্টুর মনের ভাব কিন্তু অন্যরকম। তাদের বাড়িতে অনেকদিন কেউ এসে থাকেনি। এখন তার গ্রীষ্মের ছুটি; সারাটা দিন সে বাড়িতেই থাকে। খেলার সাথীর অভাব নেই–সিধু, অনীশ, রথীন, ছোটকা–কিন্তু বাড়িতে একজন বাড়তি লোকের মজাটা আলাদা। সারাক্ষণ শুধু মা আর বাবাকে দেখতে কি ভাল লাগে? আর দাদু-কি-দাদু-নয় মজাটাও কি কম? এ যেন একটা রহস্য অ্যাডভেঞ্চার। যদি দাদু না হয়, যদি কোনও বদ মতলবে দুষ্টু লোক আসে, আর সেটা যদি মন্টু ধরে দিতে পারে, তা হলে দারুণ ব্যাপার হবে।
সোমবার সকাল সাড়ে দশটা থেকে সদর দরজার বাইরে ঘোরাঘুরি করার পর সোয়া এগারোটার সময় মন্টু দেখল একটা সাইকেল রিকশা আসছে তাদের বাড়ির দিকে। গাড়িতে একজন লোক, তার হাতে একটা মিষ্টির হাঁড়ি, আর পায়ের কাছে একটা চামড়ার সুটকেস। লোকটা সুটকেসের উপর একটা পা তুলে দিয়েছে।