শীতকালের দিন ছোট বলে এমনিতেই টিপু এবার বাড়ি ফিরবে ভাবছিল, এমন সময় একটা ব্যাপার দেখে ঝট করে গাছের আড়ালে গা-ঢাকা দিতে হল।
অঙ্ক স্যার নরহরিবাবু বই ছাতা বগলে এদিকেই আসছেন।
তা হলে কি ওঁর বাড়ি এইদিকেই? বিষ্ণুরামবাবুর বাড়ির পরে আরও গোটা পাঁচেক বাড়ি আছে অবিশ্যি এ রাস্তায়। তারপরেই হামলাটুনির মাঠ। ওই মাঠের পুব দিকে এককালে রেশমের কুঠি ছিল। হ্যামিলটন সাহেব ছিলেন তার ম্যানেজার। ভয়ংকর কড়া মেজাজের মানুষ ছিলেন তিনি। বত্রিশ বছর ম্যানেজারি করে কুঠির পাশেই তাঁর বাংলোতে মারা যান। তাঁর নামেই ওই মাঠের নাম হয়ে গেছে হামলাটুনির মাঠ।
আলো পড়ে আসা পৌষ মাসের বিকেলে জামরুল গাছের আড়াল থেকে ও দেখছে নরহরি স্যারকে। ভারী অবাক লাগছে তাঁর হাবভাব দেখে। স্যার এখন বিষ্ণুরামবাবুর ঘোড়ার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ঠোঁট ছুঁচোলো করে চুক চুক করে ঘোড়ার কাঁধে হাত বুলোচ্ছেন।
এমন সময় খুট করে বাড়ির সদর দরজা খোলার শব্দ হল, আর বিষ্ণুরামবাবু নিজেই চুরুট হাতে বেরিয়ে এলেন।
নমস্কার।
ঘোড়ার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে অঙ্ক স্যার বিষ্ণুরামবাবুর দিকে ফিরলেন। বিষ্ণুরামবাবুও নমস্কার করে বললেন, এক হাত হবে নাকি?
সেইজন্যেই তো আসা, বললেন অঙ্ক স্যার। তার মানে অঙ্ক স্যার দাবা খেলেন। বিষ্ণুরামবাবু যে খেলেন সেটা টিপু জানে। অঙ্ক স্যার এবার বললেন, দিব্যি ঘোড়াটি আপনার পেলেন কোত্থেকে?
কলকাতা। শোভাবাজারের দ্বারিক মিত্তিরের ছিল ঘোড়াটা। ওঁর কাছ থেকেই কেনা। রেসের মাঠে ছুটেছে এককালে। নাম ছিল পেগাসাস।
পেগাসাস? নামটা যেন চেনা চেনা মনে হল টিপুর, কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে করতে পারল না।
পেগাসাস বললেন অঙ্ক স্যার। কিম্ভুত নাম তো মশাই!
ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার ওইরকমই নাম হয়। হ্যাপি বার্থডে, শোভান আল্লা, ফরগেট-মি-নট…
আপনি চড়েন এ ঘোড়া?
চড়ি বইকী। তালেবর ঘোড়া। একটি দিনের জন্যও বিগডোয়নি৷
অঙ্ক স্যার চেয়ে আছেন ঘোড়াটার দিকে। বললেন, আমি এককালে খুব চড়িছি ঘোড়া।
বটে?
তখন আমরা শেরপুরে। বাবা ছিলেন ডাক্তার। ঘোড়ায় চেপে রুগি দেখতে যেতেন। আমি তখন ইস্কুলে পড়ি। সুযোগ পেলেই চড়তুম। ওঃ, সে কি আজকের কথা!
চড়ে দেখবেন এটা?
চড়ব?
চড়ুন না!
টিপু অবাক হয়ে দেখল অঙ্ক স্যার হাত থেকে বই ছাতা দাওয়ায় নামিয়ে রেখে ঘঘাড়ার দড়িটা খুলে এক ঝটকায় সেটার পিঠে চড়ে বসলেন। তারপর বাঁ পায়ের গোঁড়ালি দিয়ে ঘোড়ার পাশে দুবার চাপ দিতেই সেটা খট খট করে চলতে আরম্ভ করল।
দেখবেন, বেশিদূর যাবেন না, বললেন বিষ্ণুরামবাবু।
আপনি খুঁটি সাজান গিয়ে, বললেন অঙ্ক স্যার, আমি খানিকদূর গিয়েই ঘুরে আসছি।
টিপু আর থামল না। আজ একটা দিন গেল বটে!
কিন্তু ঘটনার শেষ এখানেই নয়।
তখন সন্ধ্যা সাতটা। টিপু পরের দিনের পড়া শেষ করে সবে ভাবছে এবার গল্পের বইটা খুলবে কিনা, এমন সময় বাবা ডাক দিলেন নীচে থেকে।
টিপু নীচে বৈঠকখানায় গিয়ে দেখে নরহরি স্যার বসে আছেন বাবার সঙ্গে। টিপুর রক্ত হিম হয়ে গেল। বাবা বললেন, তোমার দাদুর দেওয়া যে বইগুলো রয়েছে সেগুলো ইনি একবার দেখতে চাইছেন। যাও তো, নিয়ে এসো গিয়ে।
টিপু নিয়ে এল। সাতাশখানা বই। তিন খেপে আনতে হল।
অঙ্ক স্যার ঝাড়া দশ মিনিট ধরে বইগুলো দেখলেন। মাঝে মাবো মাথা নাড়েন আর হু করে একটা শব্দ করেন। তারপর বইগুলো রেখে দিয়ে বললেন–দেখুন মিস্টার চৌধুরী, আমি যেটা বলছি সেটা আমার অনেকদিনের চিন্তা-গবেষণার ফল। ফেয়ারি টেইল বলুন আর রূপকথাই বলুন আর উপকথাই বলুন, এর ফল হচ্ছে একই–ছেলেমেয়েদের মনে কুসংস্কারের বীজ বপন করা। শিশুমনকে যা বোঝাবেন তাই তারা বুঝবে। সেখানে আমাদের বড়দের দায়িত্বটা কতখানি সেটা একবার ভেবে দেখুন! আমরা কি তাদের বোঝাব, বোয়াল মাছের পেটে থাকে মানুষের প্রাণ?–যেখানে আসল কথাটা হচ্ছে। যে প্রাণ থাকে মানুষের হৃৎপিণ্ডে–তার বাইরে কোথাও থাকতে পারে না, থাকা সম্ভব নয়।
বাবা পুরোপুরি কথাটা মানছেন কিনা সেটা টিপু বুঝতে না পারলেও, এটা সে জানে যে, ইস্কুলের মাস্টারদের কথা যে মেনে চলতে হয়, এটা তিনি বিশ্বাস করেন। ছেলেবয়সটা মেনে চলারই বয়স, টিপু, একথা বাবা অনেকবার বলেছেন। বিশেষ করে গুরুজনদের কথা মানতেই হবে। নিজের ইচ্ছেমতো সবকিছু করার বয়সও আছে একটা, কিন্তু সেটা পড়াশুনো শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর। তখন তোমাকে কেউ বলবে না এটা করো, ওটা করো। বা বললেও, সেখানে তোমার নিজের মতটা দেবার অধিকার আছে। কিন্তু সেটা এখন নয়।
আপনার বাড়িতে অন্য ধরনের শিশুপাঠ্য বই নেই? জিজ্ঞেস করলেন নরহরি স্যার।
আছে বইকী,বললেন বাবা। আমার বুক শেলফেই আছে। আমার ইস্কুলে প্রাইজ পাওয়া বই। টিপু তুই দেখিসনি?
সব পড়া হয়ে গেছে বাবা, বলল টিপু।
সবগুলো?
সবগুলো। বিদ্যাসাগরের জীবনী, সুরেশ বিশ্বাসের জীবনী, ক্যাপ্টেন স্কটের দক্ষিণ মেরু অভিযান, মাঙ্গো পার্কের আফ্রিকা ভ্রমণ, ইস্পাতের কথা, আকাশযানের কথা… প্রাইজ আর কটাই বা পেয়েছ বাবা?
তা বেশ তো, বললেন বাবা। নতুন বই এনে দেওয়া যাবেখন।
আপনি এখানে তীর্থঙ্কর বুক স্টলে বললে ওরা কলকাতা থেকে আনিয়ে দেবে বই, বললেন অঙ্ক স্যার, সেইসবই তুমি পড়বে এবার থেকে, তর্পণ। এগুলো বন্ধ।