অত জানলে জিঞ্জিরিয়া হবে।
লোকটা আসলে জিঞ্জিরিয়া বলেনি; বলেছিল একটা ভীষণ কঠিন কথা যেটা টিপু চেষ্টা করলেও উচ্চারণ করতে পারবে না। তবে খুব সহজ করে বললে সেটা জিঞ্জিরিয়াই হয়। না জানি কী ব্যারামের কথা বলছে, তাই টিপু আর ঘাঁটাল না। কার কথা মনে হচ্ছে লোকটাকে দেখে? রামখেল তিলক সিং? না কি ঘ্যাঁঘাসুরের সেই একহাত লম্বা লোকটা, যার সঙ্গে মানিকের দেখা হয়েছিল? নাকি স্নো হোয়াইটের সেই সাতটা বামুনের একটা বামুন? টিপু রূপকথার পোকা। তার দাদু প্রতিবারই পুজোয় কলকাতা থেকে আসার সময় তার জন্য তিন-চারখানা করে রূপকথার বই এনে দেন। টিপুর মনটা সে সব পড়ে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী ছত্রিশ পাহাড় পেরিয়ে কোথায় যেন উড়ে চলে যায়। সে নিজেই হয়ে যায় রাজপুত্তুর–তার মাথায় মুক্তো বসানো পাগড়ি, আর কোমরে হিরে বসানো তলোয়ার। কোনওদিন চলেছে গজমোতির হার আনতে, কোনওদিন ড্রাগনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে।
গুড বাই।
সে কী, লোকটা যে চলল।
কোথায় থাকো তুমি, বললে না?
লোকটা তার প্রশ্নে কান না দিয়ে শুধু বলল, তোমার দুঃখ হলে তখন আবার দেখা হবে।
কিন্তু তোমায় খবর দেব কী করে?
ততক্ষণে লোকটা এক লাফে একটা দেড় মানুষ উঁচু কুলগাছ টপকে হাইজাম্পে ওয়র্লড রেকর্ড করে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
এটা প্রায় দেড়মাস আগের ঘটনা। তারপর থেকে লোকটা আর আসেনি। কিন্তু এখন তো আসা দরকার, কারণ টিপুর সত্যিই দুঃখের কারণ হয়েছে। আর সেই কারণ হল তাদের ইস্কুলের নতুন অঙ্কের মাস্টার নরহরিবাবু।
নতুন মাস্টারমশাইকে টিপুর এমনিতেই ভাল লাগেনি। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকে কিছু বলার আগে প্রায় দুমিনিট খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে সারা ক্লাসের ছাত্রদের উপর যেভাবে চোখ বোলালেন তাতে মনে হয় যেন আগে সকলকে ভস্ম করে তারপর পড়াতে শুরু করবেন। তালগাছের হুসুর মুসুরের মতো এমন ঝাঁটা গোঁফ যে সত্যি-মানুষের হয় সেটা টিপু জানতই না। তার ওপর ওরকম মুখে-হাঁড়িধা গলার আওয়াজ। ক্লাসের কেউই তো কালা নয়, তা হলে অত হুমকিয়ে কথা বলার দরকার কী?
আসল গোলমালটা হল দুদিন পরে, বিষুদবারে। দিনটা ছিল মেঘলা, তার উপর পৌষ মাসের শীত। টিফিনের সময় টিপু ক্লাস থেকে না বেরিয়ে নিজের ডেস্কে বসে পড়ছিল ডালিমকুমারের গল্প। কে জানত ঠিক সেই সময়ই অঙ্কের স্যার ক্লাসের পাশ দিয়ে যাবেন, আর তাকে দেখতে পেয়েই ক্লাসে ঢুকে আসবেন?
ওটা কী বই, তর্পণ?
স্যারের স্মরণশক্তি যে সাংঘাতিক সেটা বলতেই হবে, কারণ দুদিনেই সব ছাত্রদের নাম মুখস্থ হয়ে গেছে।
টিপুর বুকটা দুরদুর করলেও, টিফিনে গল্পের বই পড়াটা দোষের নয় মনে করে সে বলল, ঠাকুরমার ঝুলি, স্যার।
কই দেখি।
টিপু বইটা দিয়ে দিল স্যারের হাতে। স্যার মিনিট খানেক ধরে সেটা উলটেপালটে দেখে বললেন, হাঁউ মাউ কাঁউ মানুষের গন্ধ পাঁউ, হিরের গাছে মোতির পাখি, শামুকের পেটে রাজপুত্তুর–এসব কী পড়া হচ্ছে শুনি? যত আজগুবি ধাপ্পাবাজি! এসব পড়লে অঙ্ক মাথায় ঢুকবে কেমন করে, অ্যাঁ?
এ গল্প, স্যার, টিপু কোনওরকমে গলা দিয়ে আওয়াজ বার করে বলল।
গল্প? গল্পর তো একটা মাথামুণ্ডু থাকবে, না কি যেমন-তেমন একটা লিখলেই হল?
টিপু অত সহজে হার মানতে চাইছিল না। বলল, রামায়ণেও তো আছে হনুমান জাম্বুমান, আর মহাভারতে বক রাক্ষস আর হিড়িম্বা রাক্ষসী আর আরও কত কী।
জ্যাঠামো কোরো না, দাঁত খিঁচিয়ে বললেন নরহরি স্যার। ওসব হল মুনিঋষিদের লেখা, দুহাজার বছর আগে। সে তো গণেশ ঠাকুরেরও–মানুষের গায়ে হাতির মাথা, আর মা দুর্গার দশটা হাত। ও জিনিস আর তোমার এ মনগড়া গাঁজাখুরি গল্প এক জিনিস নয়। তোমরা এখন পড়বে মনীষীদের জীবনী, ভাল ভাল ভ্রমণ কাহিনী, আবিষ্কারের কথা, মানুষ কী করে ছোট থেকে বড় হয়েছে সেইসব কথা। তোমাদের বয়সে বাস্তব কথার দাম হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। তোমরা হলে বিংশ শতাব্দীর ছেলে। আদ্যিকালে পল্লীগ্রামে যে জিনিস চলত সে জিনিস আজ শহরে চলবে কী করে? এসব পড়তে হলে পাততাড়ি নিয়ে পাঠশালায় গিয়ে বসতে হবে, আর দুলে দুলে কড়াকিয়া গণ্ডাকিয়া মুখস্থ করতে হবে। সে সব পারবে তুমি?
টিপু চুপ করে রইল। এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত কথা শুনতে হবে, সেটা ও ভাবতে পারেনি।
ক্লাসে আর কে কে এসব বই পড়ে? অঙ্ক স্যার জিজ্ঞেস করলেন।
সত্যি বলতে কি, আর কেউই প্রায় পড়ে না। শীতল একবার টিপুর কাছ থেকে হিন্দুস্থানী উপকঞ্চ ধার নিয়ে গিয়েছিল, পরদিনই ফেরত দিয়ে বলল, ধুস, এর চেয়ে অরণ্যদেব ঢের ভাল।
আর কেউ পড়ে না স্যার, বলল টিপু।
হুঁ।…তোমার বাবার নাম কী?
তারানাথ চৌধুরী।
কোথায় থাকো তোমরা?
স্টেশন রোড। পাঁচ নম্বর।
হুঁ।
বইটা ঠক করে ডেস্কের উপর ফেলে দিয়ে অঙ্ক স্যার চলে গেলেন।
ইস্কুলের পর টিপু সোজা বাড়ি ফিরল না। স্কুলের পুব দিকে ঘোষদের আমবাগানটা ছাড়িয়ে বিষ্ণুরাম দাসের বাড়ির বাইরে বাঁধা সাদা ঘোড়াটার দিকে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক ভাবে চেয়ে রইল জামরুল গাছটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। বিষ্ণুরামবাবুর বিড়ির কারখানা আছে। ঘোড়ায় চড়ে কারখানায় যান। বয়স পঞ্চাশের উপর, কিন্তু এখনও মজবুত শরীর।
টিপু প্রায়ই এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘোড়াটাকে দেখে, কিন্তু আজ আর কিছু ভাল লাগছিল না। তার মন বলছে অঙ্ক স্যার তার গল্পের বই পড়া বন্ধ করার মতলব করছেন। গল্পের বই না পড়ে সে থাকবে কী করে? সারা বছরের একটা দিনও তার গল্পের বই পড়া বন্ধ থাকে না, আর সবচেয়ে ভাল লাগে ওইসব বইগুলো, যেগুলোকে অঙ্ক স্যার বললেন আজগুবি আর গাঁজাখুরি। কই, ও তো এসব বই পড়েও অঙ্কেতে কোনওদিন খারাপ করেনি! গত পরীক্ষায় পঞ্চাশে চুয়াল্লিশ পেয়েছিল। আর আগের অঙ্কের স্যার ভূদেববাবুর কাছে তো অঙ্কের জন্য কোনওদিন ধমক খেতে হয়নি!