জয়ন্ত ॥ আপনি ভিতরে আসুন।
তিনকড়িবাবু ভিতরে আসেন।
জয়ন্ত ॥ আপনি ওই চেয়ারটায় বসুন। আমি একটু ব্যস্ত আছি।
তিনকড়িবাবু টেবিলের চেয়ে একটু দূরে রাখা একটা কাঠের চেয়ারে বসে ধুতির খুট দিয়ে ঘাম মোছেন। জয়ন্ত তরুণের দিকে ফেরে।
জয়ন্ত ॥ হ্যাঁ–যা বলছিলাম। এখন সমস্যা হয়েছে আর্টিস্ট নিয়ে। এই গল্পের বেশ জোরদার ছবি না হলে চলবে না। তোর তো অনেক বই আছে লাদাখ সম্পর্কে কিছু আছে কি–ছবির বই?
তরুণ ॥ তা থাকতে পারে। আমি দেখবখন।
জয়ন্ত ॥ আমাকে যদি দিন সাতেকের জন্য ধার দিতে পারিস। এখন ছবিতে গোঁজামিল দিলে চলে না। ভাল রেফারেন্স দেখে আঁকা চাই। আশিস মিত্র ছেলেটির হাত বেশ ভাল। তোর কাছ থেকে যদি বইটা পেয়ে যাই, তা হলে ইলাসট্রেশন সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।
তরুণ ॥ তুই যে রকম বলছিল তাতে তো লেখাটা আমার এখনই পড়তে ইচ্ছে করছে। সত্যি বলতে কিশোরদের লেখা পড়তে বেশ লাগে এই বয়সেও।
রঘুনাথ মুৎসুদ্দীর প্রবেশ। তরুণের পাশেই আরেকটা চেয়ারে বসে ঘাম মোছেন।
রঘুনাথ। ॥ ভেরি সাকসেসফুল মনিং। শারদীয়া সংখ্যার জন্য কোনও চিন্তা নেই। ৬টা কালার বিজ্ঞাপন পাওয়া যাচ্ছে–আর এখন অবধি ২৪টা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট হয়েছে–ভারত ইনসিওরেন্স আর পোদ্দার বিস্কিট কথা দিয়েছে, মনে হয় হয়ে যাবে।
জয়ন্ত ॥ রেট নিয়ে কেউ গাঁইগুই করেনি তো?
রঘুনাথ ॥ নাঃ। আজকাল তো সব কাগজেই একরকম রেট হয়ে গেছে–আমাদেরটা যে খুব একটা অতিরিক্ত বেশি তা তো নয়, কাজেই আপত্তি করার তো কোনও কারণ নেই।
জয়ন্ত ॥ ম্যাটারগুলো সব ঠিক সময় পাঠিয়ে দেবে তো? গতবার বিজ্ঞাপন প্রমিস করে পাঠাতে লেট করেছিল বলে আমাদের কাগজ বেরোতে দেরি হয়ে গেল।
রঘুনাথ ॥ আমি তো পই পই করে বলে এসেছি, এখন দেখা যাক। ইয়ে ধনঞ্জয়!
পিছনের ঘর থেকে ধনঞ্জয় বেয়ারার গলা পাওয়া যায়।
ধনঞ্জয় ॥ বাবু
রঘুনাথ ॥ চট করে এক পেয়ালা চা করো তো।
রঘুনাথ পিছনের ঘরে চলে যায়।
লেখক তস্ময় সেনগুপ্ত রাস্তার দিকে দরজা দিয়ে ঢোকে।
তন্ময় ॥ (জয়ন্তকে) গুড মর্নিং স্যার।
জয়ন্ত ॥ গুড মর্নিং।
তন্ময় ॥ আমার লেখাটার বিষয় জানতে এসেছিলাম।
জয়ন্ত ॥ আপনার উপন্যাসটা?
তন্ময় ॥ হ্যাঁ।
জয়ন্ত ॥ কেন–ওটা আপনি এখনও পাননি? ওটা তো ফেরত চলে গেছে–আপনার তো স্ট্যাম্প দেওয়া ছিল। তন্ময়
তন্ময় ॥ তার মানে কি পছন্দ হল না?
জয়ন্ত ॥ আজ্ঞে না, ভেরি সরি। ওতে আপনার বিস্তর গণ্ডগোল–বিশ্বাসযোগ্যতার একান্ত অভাব। দশ-বারো বছরের ছেলেরা ওরকমভাবে কথা বলে না। আর অত সাহসও ওদের হয় না। কিছু মনে করবেন না–কিন্তু এ গল্প ছাপলে আপনার সুনাম হত না। আমি পাণ্ডুলিপির সঙ্গে একটা স্লিপ অ্যাটাচ করে আমার মন্তব্য দিয়ে দিয়েছি। আপনার তো দুটো লেখা এর আগে ছাপা হয়েছে। এটা না হয় নাই হল। তন্ময়
তন্ময় ॥ তা হলে আপনারা কি এবার উপন্যাস দিচ্ছেন না?
জয়ন্ত ॥ দিচ্ছি বই কী। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি এরকম উপন্যাস এবারের আর কোনও পুজো সংখ্যায় ছাপা হবে না।
তন্ময় ॥ নামকরা লেখক?
জয়ন্ত ॥ একেবারেই না। আমার তো মনে হয় এটিই এনার প্রথম লেখা।
তন্ময় ॥ কী নাম লেখকের?
জয়ন্ত ॥ নবারুণ চট্টোপাধ্যায়। শুনেছেন নাম?
তন্ময় ॥ না। তা শুনিনি বটে।
জয়ন্ত ॥ আমিও নামই শুনেছি, আর লেখা পড়েছি। পরিচয় হয়নি। ভদ্রলোক থাকেন সেই বাগবাজারে।
তন্ময় ॥ ভেরি লাকি বলতে হবে।
জয়ন্ত ॥ এ তো আর লাকে হয় না, ভেতরে ক্ষমতা থাকা চাই। ইদানীং কিশোরদের লেখা যা দেখেছি তার মধ্যে এটাই যে বেস্ট বাই ফার তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
তন্ময় ॥ আমি তা হলে উঠি।
জয়ন্ত ॥ আসুন। আপনার লেখা দু-একদিনেই পেয়ে যাবেন। কলকাতার ডাক তো! বালিগঞ্জ টু শ্যামবাজার চিঠি যেতে সাতদিন লাগে।
তিনকড়িবাবু তাঁর জায়গা থেকে গলা খাকরানি দেন।
তিনকড়ি ॥ ইয়ে, মানে–
জয়ন্ত ॥ আপনি আরেকটু বসুন না। শুনছি আপনার কথা।
তিনকড়ি ॥ না, মানে–যদি একটু খাবার জল পাওয়া যেত।
জয়ন্ত ॥ ধনঞ্জয়।
ধনঞ্জয় আসে।
ধনঞ্জয় ॥ বাবু?
জয়ন্ত ॥ ওই ভদ্রলোককে এক গেলাস জল দাও তো।
ধনঞ্জয় জল এনে দেয়। ভদ্রলোক ঢক ঢক করে গেলাস শেষ করে আবার ধুতির খুঁট দিয়ে কপালের ঘাম মোছেন। জয়ন্তর টেবিলের উপর একটা পাখা চলছে বটে, কিন্তু তার হাওয়া তিনকড়িবাবুর কাছে পৌঁছচ্ছে না। জয়ন্ত আবার তরুণের দিকে মন দেয়।
জয়ন্ত ॥ কাগজের কথা বলতে গিয়ে আসল কথাই ভুলে যাচ্ছিলাম। তোর ভাগনির তো বিয়ে।
তরুণ ॥ হ্যাঁ। এই তো আসছে মাসে। তোরা আসিস। তোর নামে চিঠি যাবে।
জয়ন্ত ॥ তা তো যাব, কিন্তু এই পুজো সংখ্যার চাপে টাইম করে উঠতে পারব কি না জানি না।
তরুণ ॥ ও সব শুনছি না। একটা সন্ধে দুটি ঘণ্টা তোর কাজের মধ্যে থেকে বার করে নিতে হবে।
জয়ন্ত ॥ কী বলছিস–এখন যে ক্রিকেট, তাই দেখা হল না টেলিভিশনে।
তরুণ ॥ ওয়ান-ডের খেলাটাও দেখিসনি?
জয় ॥ কোথায় আর দেখলাম।
তরুণ ॥ এঃ–খুব মিস করেছিস। এরম খেলা চট করে দেখা যায় না। তোর উপন্যাসের সাসপেন্স কোথায় লাগে।
তরুণ তার সিগারেট অ্যাশট্রেতে ফেলে দেয়।
তরুণ ॥ যাক গে–আমি আর তোর সময় নেব না।
জয়ন্ত ॥ লেখার কথাটা ভুলবি না তো?
তরুণ ॥ দেব লেখা–তবে পয়সা দিতে হবে কিন্তু। বন্ধু বলে হবে না।