রিমার্কেল! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন মামা।
কলকাতায় ফেরার সাতদিন পরে ছোটদা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরল হাতে একটা বাঁধানো মোটা বই নিয়ে। বই নয়, পত্রিকা। নাম বায়স্কোপ। বলল, নবরঙ্গ পত্রিকার এডিটর সীতেশ বাগচীর কাছে পঞ্চাশ টাকা জমা রেখে বইটা একদিনের জন্য বাড়িতে আনতে পেরেছে। দুটো পাতার মাঝখানে একটা বাসের টিকিট গোঁজা ছিল। সেই পাতায় খুলে বইটা আমার সামনে ফেলে দিল।
ডানদিকের পাতায় একটা বেশ বড় ছবি যাকে বলে ফিল্মের স্টিল, চকচকে আর্ট পেপারে ছাপা। পৌরাণিক ছবির স্টিল। ফিল্মের নাম শবরী। ছবির তলায় লেখা–প্রতিমা মুভিটোনের নির্মীয়মাণ ছায়াচিত্র শবরী-তে শ্রীরামচন্দ্র ও শবরীর ভূমিকায় যথাক্রমে নবাগত কালীকিঙ্কর ঘোষাল ও কিরণশশী।
চেহারাটা মিলিয়ে দ্যাখ, স্টুপিড, বলল ছোড়দা।
দেখলাম মিলিয়ে। কিরণশশীর চেয়ে ইঞ্চি তিনেক লম্বা–অর্থাৎ মাঝারি হাইট, খালি গা বলে বোঝা যায় গায়ের রঙ ফরসা, টিকোলো নাক, আর ডান গালে বেশ একটা বড় আঁচিল। বয়স দেখে পঁচিশের বেশি বলে মনে হয় না।
আমার কেমন যেন বুকটা খালি-খালি লাগছে। জিজ্ঞেস করলাম, এটা কবেকার ছবি, ছোড়দা?
সেপাই মিউটিনির আটষট্টি বছর পরে। নাইনটিন টোয়েন্টিফোর। সাইলেন্ট ছবি। তার হিরো হচ্ছেন কালীকিঙ্কর ঘোষাল। এই প্রথম, আর এই শেষ ছবি। তিন মাস পরের সংখ্যায় ছবির সমালোচনা আছে। বলছে নবাগত নায়ক আগমন না করিলে কোনও ক্ষতি ছিল না। চিত্রাভিনেতা হিসাবে এঁর কোনও ভবিষ্যৎ নাই।
মানে, তা হলে ওঁর বয়স–
যা মনে হয় তাই। আশি-বিরাশি। চব্বিশ সালের এ ছবিতে যদি বছর পঁচিশ বয়স হয়, তা হলে হিসেব করে দ্যাখ ওর সঙ্গে যিনি ছিলেন তিনি আসলে ওর বউ। গোপেনবাবু প্রথমে যা ভেবেছিলেন তাই।
লোকটা তা হলে একেবারে—
বোগাস। ফোর-টোয়েন্টি। ভাবছিলাম কাগজে লিখে সব ফাঁস করে দিই, কিন্তু করব না। কারণ লোকটার ব্রেনটা শার্প আছে। সেটার তারিফ করতেই হয়। যখন বয়স ছিল তখন রাম-হড়কান হড়কেছে, কিন্তু শেষ বয়সে দেখিয়ে তো দিল–একটি মিথ্যে কথা বলে কী করে স্পটলাইটটা টপ স্টারের উপর থেকে টেনে এনে নিজের উপর ফেলতে হয়!
সন্দেশ, পৌষ ১৩৮৯
হাউই (নাটক)
জয়ন্ত নন্দী : ছোটদের পত্রিকা হাউই-এর সম্পাদক
তরুণ সান্যাল : জয়ন্তর বন্ধু
তিনকড়ি ধাড়া : হাউই-এর দপ্তরের কর্মচারী। কাজ–বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা
তন্ময় সেনগুপ্ত : লেখক
মুকুল : দপ্তরের কর্মচারী
ধনঞ্জয়/আলম : দপ্তরের বেয়ারা
অর্দ্বেন্দু রায় : জনৈক গ্রাহকের বাবা
.
বালিগঞ্জে ছোটদের পত্রিকা হাউই-এর দপ্তর। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল–তার পিছনে একটা চেয়ারে সম্পাদক জয়ন্ত নন্দী বসে আছে। জয়ন্তর বয়স বছর ৩৫। তার উলটোদিকে দুটো চেয়ারের মধ্যে একটায় তার বন্ধু তরুণ সান্যাল হাতে একটি সিগারেট নিয়ে বসে। ঘরের একপাশে দেখা যাচ্ছে বেয়ারা আলম নতুন হাউই পত্রিকা ডাকে দেবার জন্য সেগুলো ব্রাউন কাগজের প্যাকেটে ভরছে। পিছন দিকে মঞ্চের মাঝখানে একটা বন্ধ দরজা, তার পিছনেও একটা ঘর আছে বোঝা যায়। বন্ধ দরজার পাশে একটা খালি চেয়ার। জয়ন্ত আর তরুণের সামনেই চায়ের পেয়ালা। তরুণ তার কাপে চুমুক দিয়ে সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে।
তরুণ ॥ তা হলে তোদের অবস্থা বেশ ভালই বলছিস?
জয় ॥ তা ভাই তেরো হাজার সাবস্ক্রিপশন, স্টল থেকে হাজার চারেক বিক্রি হয়–খারাপ আর কী করে বলি বল। আর বিজ্ঞাপন থেকেই খরচা উঠে আসে। এ মাসে তো চারখানা রঙিন বিজ্ঞাপন আছে, তার মধ্যে দুটো রেগুলার আর দুটো অকেশনাল। ছাপাও খারাপ হচ্ছে না। আগের প্রেসটা সুবিধের ছিল না। গত বৈশাখ থেকে প্রেস বদলেছি–এখন বেশ ঝরঝরে হয়েছে। এই যে দেখ না—
জয়ন্ত একটা পত্রিকা টেবিলের উপর থেকে তুলে তরুণকে দেয়। তরুণ সেটা উলটেপালটে দেখে।
জয়ন্ত ॥ তোর তো লেখার হাত বেশ ভাল ছিল। একটা লেখ না আমাদের কাগজের জন্য।
তরুণ ॥ পয়সা দিচ্ছিস লেখকদের?
জয় ॥ তা দিচ্ছি বই কী। নেহাত খারাপ নয়। একটা গল্পের জন্য একশো টাকা। উপন্যাস হলে ফাইভ হান্ড্রেড। অবিশ্যি লেখক নতুন না নামী তার উপর রেট খানিকটা নির্ভর করছে।
তরুণ ॥ নামটিও কাগজের ভাল হয়েছে। হাউই। ভেরি অ্যাট্রাকটিভ।
জয়ন্ত ॥ এই পুজোর জন্য একটা উপন্যাস পেয়েছি–সম্পূর্ণ অপরিচিত লেখক নাম নবারুণ চট্টোপাধ্যায়। তোকে বলছি এমন ট্যালেন্টেড লেখক সচরাচর চোখে পড়ে না। আমি তো পড়ে তাজ্জব। ভদ্রলোক থাকেন আবার বাগবাজারেনা হলে একবার ডেকে এনে আলাপ করার ইচ্ছে ছিল।
তরুণ ॥ কী ধরনের উপন্যাস?
জয়ন্ত ॥ অ্যাডভেঞ্চার। যেমন সব চরিত্র, তেমনি পরিবেশ, তেমনি সাসপেন্স। লাদাখ-এর ব্যাকগ্রাউন্ড। লোকটা হয় নিজে গেছে, না হয় প্রচুর পড়াশোনা করে লিখেছে। আমি তো পড়ে মোহিত।
ডানদিকে দপ্তরের রাস্তার দিকের দরজায় টোকা পড়ে। একজন বেঁটে, নিরীহ ভদ্রলোক, মাথায় টাক, পরনে গেরুয়া পাঞ্জাবি এবং খাটো ধুতি, দরজার মুখটায় এসে দাঁড়িয়েছে। এর নাম তিনকড়ি ধাড়া।
তিনকড়ি ॥ এটা কি হাউই পত্রিকার আপিস?
জয়ন্ত ॥ আজ্ঞে হ্যাঁ।
তিনকড়ি ॥ আমার একটু সম্পাদক মশাইয়ের সঙ্গে দরকার ছিল।
জয়ন্ত ॥ আমিই সম্পাদক–আপনার কী দরকার?
তিনকড়ি ॥ সেটা, মানে, বসে বলতে পারলে ভাল হত।