ডট পেনে আওয়াজ নেই। তবে আড়চোখে দেখছি ছেনিদা দাঁতে দাঁত চেপে ঝড়ের বেগে লিখে চলেছে। টেপরেকর্ডারটার ব্যাটারি খতম, সেটা টের পেয়েছে আসার দিন, রোববারে। তাই কলম ছাড়া গতি নেই। সঙ্গে একটা ধার করা পেনট্যাক্স ক্যামেরা আছে। কোনও একটা সময়ে সেটার সদ্ব্যবহার হবে নিশ্চয়ই। ছবি ছাড়া এ লেখা ছাপা হবে কী করে?
কিছু মনে করবেন না, ফাঁক পেয়ে বললেন মামা, আমি আবার একটু পামিস্ত্রির চর্চা-টর্চা করি। বিলিতি মতে অবশ্য। তা, আপনার হাতখানা যদি একবার দেখতে দেন। শুধু একবারটি চোখ বুলব।
দেখুন না।
কালী ঘোষাল ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন, মামা হাতটা ধরে তার উপর ঝুঁকে পড়ে মিনিট খানেক দেখে মাথা নেড়ে বললেন, ন্যাচারেলি। ন্যাচারেলি। আপনার বয়সের সঙ্গে তাল রেখে আয়ুরেখাকে বাড়তে গেলে সেটা হাত ছেড়ে কবজিতে এসে নামবে। আসলে শতায়ু বা শতাধিক আয়ুর জন্য মানুষের হাতে কোনও প্রভিশন নেই। থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।
এবার বাবা বললেন, আপনার স্মরণশক্তি কি এখনও, মানে–?
মোটামুটি ভালই আছে, বললেন কালী ঘোষাল।
কলকাতায় কি আপনি একেবারেই আসেননি? প্রশ্ন করল ছেনিদা।
এসেছি বইকী! পড়াশুনা তো হেয়ার স্কুল আর সংস্কৃত কলেজে। কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে হস্টেলে থাকতুম।
ঘোড়ার ট্রাম–?
ঢের চড়িছি। দু পয়সা ভাড়া ছিল লালদিঘি টু ভবানীপুর। রিকশা ছিল না তখন। পালকির একটা বড় স্ট্যান্ড ছিল শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড়ে। পালকি বেহারাদের স্ট্রাইক হয় একটা, সেকথাও মনে আছে। আজকাল যেমন রাস্তাঘাটে কাক-চড়ুই, তখন হাড়গিলে চরে বেড়াত কলকাতার রাস্তায়। বলত স্ক্যাভেঞ্জার বার্ড। আবর্জনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেত। প্রায় আমার কাঁধের হাইট, তবে একদম নিরীহ।
তখনকার কোনও বিখ্যাত পার্সোনালিটিকে মনে পড়ে? ছেনিদাই চালিয়ে যাচ্ছে প্রশ্ন।
বিখ্যাত মানে, রবীন্দ্রনাথকে পরে দেখিছি অনেক। আলাপ অবশ্যই ছিল না; আমি আর এমন একটা কে যে-আলাপ থাকবে। তবে একবার তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথকে দূর থেকে দেখেছিলাম। কবিতা আবৃত্তি করলেন। হিন্দু মেলায়।
সে তো বিখ্যাত ঘটনা! বললেন বাবা।
বঙ্কিমচন্দ্রকে দেখিনি কখনও। একটানা কলকাতায় থাকলে হয়তো দেখা পেতুম। কিন্তু আমি কলেজের পাঠ শেষ করেই দেশে ফিরে যাই। তবে হ্যাঁ, বিদ্যাসাগর। সে এক ব্যাপার বটে! হেদোর পাশ দিয়ে হাঁটছি আমরা তিন বন্ধুতে, বিদ্যাসাগর আসছেন উলটো দিক থেকে। মাথায় ছাতা, পায়ে চটি, কাঁধে চাদর। আমার চেয়েও মাথায় খাটো। ফুটপাথে কে জানি কলা খেয়ে ছোবড়া ফেলেছে, বিদ্যাসাগরের পা পড়তেই পপাত চ। আমরা তিনজন দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে ধরাধরি করে তুললুম। হাতের ছাতা ছিটকে পড়েছে রাস্তায়, সেটাও তুলে এনে দিলুম। ভদ্রলোক উঠে কী করলেন জানেন? এ জিনিস ওঁর পক্ষেই সম্ভব। যে ছোবড়ায় আছাড় খেলেন সেটা বাঁ হাত দিয়ে তুলে নিয়ে কাছে ডাস্টবিন ছিল, তার মধ্যে ফেলে দিলেন।
আমরা আরও আধ ঘণ্টা ছিলাম। তার মধ্যে চা এল আর তার সঙ্গে নির্ঘাত নাতবউয়ের তৈরি ক্ষীরের ছাঁচ। শেষকালে যখন বিদায় নিতে উঠলাম, ততক্ষণে ছেনিদা একটা টাটকা নতুন নোটবুকের প্রায় অর্ধেক ভরিয়ে ফেলেছে। সেইসঙ্গে অবিশ্যি ছবিও থুলেছে খান দশেক। সেই ফিল্ম পার্সেল করে চলে গেল কলকাতায় ছেনিদার খবরের কাগজের আপিসে। সেইখানেই ছবি ডেভেলপিং প্রিন্টিং হয়ে ভাল ছবি বাছাই করে কাগজে বেরোবে।
পাঁচদিনের মধ্যে ছেনিদার লেখা ছবিসমেত কাগজে বেরিয়ে সে কাগজ আমাদের হাতে চলে এল। লেখার মাথায় বড় বড় হরফে হেডলাইন-বিদ্যাসাগরের হাত ধরে তুলেছিলাম আমি।
ছেনিদা স্কুপ করল ঠিকই, আর তার ফলে আপিসে তার যে কদর বেড়ে যাবে তাতেও সন্দেহ নেই, কিন্তু ওর পরে আমরা থাকতে থাকতেই কলকাতার আরও সাতখানা দিশি-বিলিতি কাগজের সাংবাদিক এসে কালী ঘোষালের ইন্টারভিউ নিয়ে গেল।
ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটেছে, সেটা বলা হয়নি। ফিল্ম স্টার অংশুমান চ্যাটার্জি তার চেলাচামুণ্ডাদের নিয়ে মার্সেডিজ গাড়ি করে দশদিনের ছুটি পাঁচদিনে খতম করে কলকাতায় ফিরে গেছে। তার নাকি হঠাৎ শুটিং পড়ে যাওয়াতে এই ব্যবস্থা। শর্মি খুব একটা আফসোস করল না, কারণ এই ফাঁকে তার অটোগ্রাফ নেওয়ার কাজটা সে সেরে নিয়েছে। সত্যি বলতে কি, খাতা নিয়ে যখন অংশুমানের সঙ্গে দেখা করে, তখন তোমার নাম কী খুকি? জিজ্ঞেস করাতে হিরোর উপর থেকে অন্তত সিকিভাগ ভক্তি তার এমনিতেই চলে গিয়েছিল। তারপর বিশ্বের অন্যতম প্রাচীনতম মানুষের সাক্ষাৎ পেয়ে তার মন ভরে গেছে। বাবা বললেন, সে থাকতে একটা বুড়ো-হাবড়াকে নিয়ে এত মাতামাতি হচ্ছে এটা বোধ হয় স্টার বরদাস্ত করতে পারলেন না।
.
আমরা ফিরে আসার আগের দিন রাত্রে কালী ঘোষাল আর তার নাতবউ আমাদের বাড়িতে খেলেন। অল্পই খান ভদ্রলোক, তবে যেটুকু খান তৃপ্তি করে খান। জীবনে কখনও ধূমপান করিনি, তা ছাড়া পরিমিত আহার, দুবেলা হাঁটা, এইসব কারণেই বোধহয় যমরাজ আমার দিকে এগোতে সাহস পাননি!
আপনার ফ্যামিলিতে আর কেউ খুব বেশিদিন বেঁচেছিলেন কি? জিজ্ঞেস করলেন বাবা।
তা বেঁচেছিলেন বইকী! শতাধিক আয়ুর সৌভাগ্য আমার পিতামহ প্রপিতামহ দুজনেরই হয়েছিল। প্রপিতামহ তন্ত্রসাধনা করতেন। একশো তেরো বছর বয়সে হঠাৎ একদিন ঠাকুরদাকে ডেকে বললেন, গঙ্গাযাত্রার আয়োজন কর। আমার সময় এসেছে। অথচ বাইরে থেকে ব্যাধির কোনও লক্ষণ নেই। চামড়া টান, দাঁত পড়েনি একটাও, চুলে যৎসামান্য পাক ধরেছে। যাই হোক, অন্তৰ্জলির ব্যবস্থা হল। হরনাথ ঘোষাল শিবের নাম করতে করতে কোমর অবধি গঙ্গাজলে শোয়া অবস্থায় চক্ষু মুদলেন। আমি পাশে দাঁড়িয়ে। আমার বয়স তখন বেয়াল্লিশ। সে দৃশ্য ভুলব না কখনও।