লোকটির স্বাস্থ্য কেমন? মামা জিজ্ঞেস করলেন।
সকাল বিকেল ডেইলি দুমাইল।
হাঁটেন!
হাঁটেন। লাঠি একটা নেন হাতে। তবে সে তো আমিও নিই। ভেবে দেখুন, আমার দ্বিগুণ বয়স!
ভদ্রলোকের আয়ুরেখাটা…
মামা ওয়ান-ট্রাক মাইন্ড।
দেখবেন হাত, বললেন গোপেনবাবু, বললেই দেখাবেন।
ছেনিদা এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, হঠাৎ টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল।–স্টোরি। এর চেয়ে ভাল স্টোরি হয় না। এ একেবারে স্কুপ।
তুই কি এখনই যাবি নাকি? প্রশ্ন করলেন বাবা।
একশো-ছাব্বিশ বয়স, বলল ছেনিদা। এরা কীভাবে মরে জানো তো? এই আছে, এই নেই। ব্যারাম-ট্যারামের দরকার হয় না। সুতরাং সাক্ষাৎকার যদি নিতে হয় তো এই বেলা। পরে দর্শনের হিড়িক পড়ে গেল আর চান্স পাব?
বোস! বাবা একটু ধমকের সুরেই বললেন। সবাই একসঙ্গে যাব। তোর তো একার প্রশ্ন নেই, আমাদের সকলেরই আছে। খাতা নিয়ে যাস, নোট করে নিবি।
বোগাস।
কথাটা বলল ছোটদা। আর বলেই আবার দ্বিতীয়বার জোরের সঙ্গে বলল, বোগাস! ধাপ্পা। গুল।
মানে? গোপেনবাবুর মোটেই পছন্দ হয়নি কথাগুলো। দ্যাখো সুরঞ্জন শেকসপিয়র পড়েছ তো? দেয়ার আর মোর থিংস ইন হেন অ্যান্ড আর্থ জানা আছে তো? সব ব্যাপার বোগাস বলে উড়িয়ে দিলে চলে না।
ছোটা গলা খাঁকরে নিল।
আপনাকে একটা কথা বলছি গোপেনবাবু–আজকাল প্রমাণ হয়ে গেছে যে, যারা একশো বছরের বেশি বয়স বলে ক্লেম করে তারা হয় মিথ্যেবাদী না হয় জংলি ভূত। রাশিয়ার হাই অলটিচিউডে একটা গ্রামে শোনা গিয়েছিল মেজরিটি নাকি একবোর বেশি বয়স, আর তারা এখনও ঘোড়া-টোড়া চড়ে। এই নিয়ে ইনভেসটিগেশন হয়। দেখা যায় এরা সব একেবারে প্রিমিটিভ। তাদের জন্মের কোনও রেকর্ডই নেই। পুরনো কথা জিজ্ঞেস করলে সব উলটোপালটা জবাব দেয়। নব্বই-এর গাঁট পেরোনো চাট্টিখানি কথা নয়। লঞ্জিভিটির একটা লিমিট আছে। নেচার মানুষকে সেইভাবেই তৈরি করেছে। বার্নার্ড শ, বাট্রান্ড রাসেল, পি জি উডহাউস–কেউ পৌঁছতে পারেননি একশো। যদুনাথ সরকার পারেননি। সেঞ্চুরি কি মুখের কথা? আর ইনি বলছেন একশো-ছাব্বিশ। হু!
জোরো আগার নাম শুনেছিস? খেঁকিয়ে প্রশ্ন করলেন মামা।
না। কে জোরো আগা?
তুর্কির লোক। কিংবা ইরানের। ঠিক মনে নেই। থার্টি ফোর-থার্টি ফাইভের কথা। একশো চৌষট্টি বছরে মারা যায়। সারা বিশ্বের কাগজে বেরিয়েছিল মৃত্যুসংবাদ।
বোগাস।
ছোটদা মুখে যাই বলুক, কালী ঘোষালের বাড়ি যখন গেলাম আমরা, সে বোধহয় অবিশ্বাসটাকে আরও পাকা করার জন্যই আমাদের সঙ্গে গেল। গোপেনবাবুই নিয়ে গেলেন। বাবা বললেন, আপনি আলাপটা করিয়ে দিলে অনেক সহজ হবে। চেনা নেই শোনা নেই, কেবল একশো ছাব্বিশ বয়স বলে দেখা করতে যাচ্ছি, এটা যেন কেমন কেমন লাগে। ছেনিদা অবিশ্যি সঙ্গে নোটবুক আর দুটো ডট পেন নিয়েছে। মা বললেন, আজ তোমরা আলাপটা সেরে এসো। আমি এর পরদিন যাব।
.
কালী ঘোষালের বাড়ির সামনের বারান্দায় বেতের চেয়ার, কাঠের চেয়ার, মোড়া আর টুলের বহর দেখে বুঝলাম সেখানে রেগুলার লোকজন আসতে শুরু করেছে। ব্রেকফাস্টের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা, কারণ গোপেনবাবু বললেন ওটাই বেস্ট টাইম। গোপেনবাবুর ঘোষাল সাহেব বাড়ি আছেন? হাঁকের মিনিট খানেকের মধ্যেই ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। মন খালি বলছে একশো ছাব্বিশ–একশো ছাব্বিশ–অথচ চেহারা দেখলে সত্যিই আশির বেশি মনে হয় না। ফরসা রং, বাঁ গালে একটা বেশ বড় আঁচিল, টিকোলো নাক, চোখে পরিষ্কার চাহনি, কানের দুপাশে দুগোছা পাকা চুল ছাড়া বাকি মাথায় চকচকে টাক। এককালে দেখতে বোধহয় ভালই ছিলেন, যদিও হাইট পাঁচ ফুট ছয়-সাতের বেশি নয়। গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, পাজামা, কটকি চাদর, পায়ে সাদা কটকি চটি। চামড়া যদি কুঁচকে থাকে তো চোখের দুপাশে আর থুতনির নীচে।
আলাপের ব্যাপারটা সারা হলে ভদ্রলোক আমাদের বসতে বললেন। ছোটদা থামের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার মতলব করেছিল বোধহয়, বাবা রঞ্জু, বোস না বলতে একটা টুলে বসে পড়ল। সে এখনও গম্ভীর।
এভাবে আপনার বাড়ি চড়াও করাতে ভারী লজ্জিত বোধ করছি আমরা, বললেন বাবা, তবে বুঝতেই পারছেন, আপনার মতো এমন দীর্ঘজীবী মানুষ তো দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তাই…
ভদ্রলোক হেসে হাত তুলে বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, অ্যালোলোজাইজ করার কোনও প্রয়োজন নেই। একবার যখন বয়সটা বেরিয়ে পড়েছে, তখন লোকে আসবে সেটা তো স্বাভাবিক। বয়সটাই যে আমার বিশেষত্ব, ওটাই একমাত্র ডিস্টিংশন–সেটা কি আর বুঝি না? আর আপনারা এলেন কষ্ট করে, আপনাদের সাথে আলাপ হল, এ তো আনন্দের কথা।
তা হলে একটা কথা বলেই ফেলি, বললেন বাবা। একটা অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন। আমার এই ভাইপোটি, নাম শ্রীকান্ত চৌধুরী, হল সাংবাদিক। এর খুব শখ আপনার সঙ্গে যে কথাবার্তা হয় সেটা ওর কাগজে ছাপায়। অবিশ্যি যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
আপত্তি কীসের? ভদ্রলোক অমায়িক হেসে বললেন। শেষ জীবনে যদি খানিকটা খ্যাতি আসে, সে তো আমারই ভাগ্য। গণ্ডগ্রামে কেটেছে সারাটা জীবন। তুলসীয়ার নাম শুনেছেন? শোনেননি। মুর্শিদাবাদে। রেলের কানেকশন নেই। বেলডাঙা জানেন তো? বেলডাঙায় নেমে সতেরো কিলোমিটার দক্ষিণে। তুলসীয়ায় জমিদারি ছিল আমাদের। সে সব তো আর নেই, তবে বাড়িটা আছে। তারই এক কোনায় পড়ে আছি। সেখানকার লোকে বলে যমের অরুচি। বলবে নাই বা কেন! গৃহিণী গত হয়েছেন বাহান্ন বছর আগে। ভাই বোন ছেলে মেয়ে কেউ নেই। নাতি আছে একটি, ডাক্তারি করে, তারও আসার কথা ছিল; এক রুগির এখন-তখন অবস্থা, তাই শেষ মুহূর্তে আসতে পারলে না। একাই আসতে পারতুম, চাকর সঙ্গে ছিল, নাতবউ দিলে না। সে এসেছে সঙ্গে। এই তিনদিনেই পুরো সংসার পেতে বসেছে। ঘড়ির কাঁটার মতো চলছে সব।