ছেনিদা আমার খুড়তুতো ভাই। সে সাংবাদিক, খবরের কাগজের আপিসে কাজ করে, ছুটি প্রায় পায় বললেই চলে। এবার এসেছে ঝিকুড়িতে সাঁওতালদের একটা পরব হয় এই সময়, সেই নিয়ে একটা ফিচার লিখতে। সে বলল, এই ফাঁকে অংশুমানের সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকারের সুযোগ তাকে নিতেই হবে।লোকটা বছরে তিনশো সাতষট্টি দিন শুটিং করে; ছুটির মওকা কী করে পেল সেটাই তো একটা স্টোরি।
একমাত্র ছোটদারই কোনও তাপ নেই। ও প্রেসিডেন্সিতে পড়া ভয়ংকর সিরিয়াস ছেলে। ফিল্ম সোসাইটির মেম্বার, জার্মান সুইডিশ ফরাসি কিউবান ব্রেজিলিয়ান ছবি দেখে, বাংলা ছবি নিয়ে একটা কড়া থিসিস লিখবে বলে ফাঁকে ফাঁকে পড়াশুনা করছে। অংশুমানের বিনিদ্র রজনী ছবি টেলিভিশনে তিন মিনিট দেখে ডিসগাসটিং বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তাকে দেখে মনে হয় এবারের ছুটিটাই মাটি; ফিল্মস্টার এসে এমন সুন্দর চেঞ্জের জায়গার আবহাওয়াটা নষ্টই করে দিয়েছে।
যারা চেঞ্জে আসে তারা ছাড়াও বাঙালি এখানে দু-চারজন আছেন যাঁরা এখানেই থাকেন। তার মধ্যে গোপেনবাবু একজন। একটা ছোট্ট বাড়ি করে আছেন এখানে বাইশ বছর, চাষের জমিও নাকি আছে কিছু। বয়স বোধ হয় বাবার চেয়ে বছর পাঁচেকের বেশি, রসিক মানুষ, উনি এলেই মনটা খুশি-খুশি হয়ে যায়।
আমরা পৌঁছানোর দুদিন পরেই ভদ্রলোক সকালে এসে হাজির, খদ্দরের পাঞ্জাবির সঙ্গে মালকোঁচা-মারা ধুতি, হাতে বাঁকানো লাঠি আর পায়ে ব্রাউন কেডস জুতো। বাংলোর বাইরে থেকেই হাঁক দিলেন ভদ্রলোক–চৌধুরী সাহেব আছেন নাকি?
আমরা চা খাচ্ছিলাম, বাবা ভদ্রলোককে ডেকে এনে বসালেন আমাদের সঙ্গে।
ওরে বাবা, এ যে দেখছি এলাহি কারবার! বললেন ভদ্রলোক। আমি কিন্তু শুধু এক কাপ চা।
গতবারে ভদ্রলোকের চোখে ছানি ছিল, বললেন মার্চ মাসে কলকাতায় গিয়ে কাটিয়ে এসেছেন। দিব্যি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।
এবার তো এখানে রমরমা ব্যাপার মশাই, বললেন বাবা।
কেন? ভদ্রলোকের ভুরু কুঁচকে গেছে।
বাবা বললেন, সে কী মশাই, তারার হাট বসে গেছে এখানে, আর আপনি জানেন না?
তার মানে আপনার দৃষ্টি এখনও ফরসা হয়নি, বললেন ছোটমামা, এতবড় ফিল্ম স্টার এসে রয়েছে এখানে, শহরে হইহই পড়ে গেছে, আর আপনি সে খবর রাখেন না?
ফিল্ম স্টার? গোপেনবাবুর ভুরু এখনও কুঁচকোনো৷ ফিল্ম স্টার নিয়ে এত মাতামাতি করার কী আছে মশাই? ফিল্মস্টার মানে তো শুটিং স্টার। তারা তো শুটিং করে শুনেছি। শুটিং স্টার জানেনা তো, সুমোহন?আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন গোপেনবাবু–আজকে আছে, কালকে নেই। ফস করে খসে পড়বে আকাশ থেকে আর বায়ুমণ্ডলে যেই প্রবেশ করল অমনই পুড়ে ছাই। তখন পাত্তাই পাওয়া যাবে না তার।
ছোটদার একটা ছোট্ট চাপা কাশিতে বুঝলাম গোপেনবাবুর কথাটা তার মনে ধরেছে।
আসল স্টারের খবরটা তা হলে পৌঁছয়নি আপনাদের কাছে? গরম চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করললেন গোপেনবাবু।
আসল স্টার?
প্রশ্নটা করলেন বাবা, কিন্তু সকলেরই দৃষ্টি গোপেনবাবুর দিকে, সকলেরই মনে এক প্রশ্ন।
গির্জার পিছনদিকে কলুটোলার চাটুজ্যেদের একটা বাগানওয়ালা একতলা বাড়ি আছে দেখেছেন তো? সেইখেনে এসে রয়েছেন ভদ্রলোক। নাম বোধ হয় কালিদাস বা কালীপ্রসাদ বা ওইরকম একটা কিছু। পদবি ঘোষাল।
স্টার বলছেন কেন? বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
বলব না? একেবারে পোল স্টার। স্টেডি। ইন্টারন্যাল। একশোর ওপর বয়স, কিন্তু দেখে বোঝার জো নেই।
বলেন কী! সেঞ্চুরিয়ন? মামার হাঁয়ের মধ্যে চিবোনো টোস্টের অনেকটা এখনও গেলা হয়নি।
সেঞ্চুরি প্লাস টোয়েনটি-সিক্স। একশো ছাব্বিশ বছর বয়স ভদ্রলোকের। জন্ম এইটিন-ফিফটিসিক্স। সিপাহি বিদ্রোহের ঠিক এক বছর আগে। রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন এইটিন সিক্সটি-ওয়ান।
আমাদের কথা বন্ধ, খাওয়া বন্ধ। গোপেনবাবু আবার চুমুক দিলেন চায়ে।
প্রায় এক মিনিট কথা বন্ধের পর ছোটদা প্রশ্ন করল, বয়সটা আপনি জানলেন কী করে? উনি নিজেই বলেছেন?
নিজে কি আর যেচে বলেছেন? অতি অমায়িক ভদ্রলোক। নিজে বলার লোকই নন। কথায় কথায় বেরিয়ে পড়ল। দেখে মনে হবে আশি-বিরাশি। ওঁরই বাড়ির বারান্দায় বসে কথা হচ্ছিল। একবার পর্দার ফাঁক দিয়ে এক মহিলাকে দেখলুম, পাকা চুল, চোখে সোনার চশমা, পরনে লালপেড়ে শাড়ি। কথাচ্ছলে শুধোলুম–আপনার গিন্নির এখানকার ক্লাইমেট সুট করছে তো? ভদ্রলোক স্মিতহাস্য করে বললেন, গিন্নি নয়, নাতবউ। আমি তো থ। বললুম, কিছু মনে করবেন না, কিন্তু আপনার বয়সটা–? কত মনে হয়? জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক। বললুম, দেখে তো মনে হয় আশি-টাশি। আবার সেই মোলায়েম হাসি হেসে বললেন, অ্যাড অ্যানাদার ফর্টি-সিক্স। বুঝুন তা হলে। সোজা হিসেব।
.
এর পর ব্রেকফাস্টটা ঠিকমতো খাওয়া হল না। এমন খবরে খিদে মরে যায়। ভারতবর্ষেরনা, শুধু ভারতবর্ষ কেন–খুব সম্ভবত সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘায়ু লোক এখানে এসে রয়েছেন, আমরা যখন রয়েছি তখনই রয়েছেন, এটা ভাবতে মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।
দেখে আসুন গিয়ে, বললেন গোপেনবাবু। এমন খবর তো চেপে রাখা যায় না, তাই বললুম দু-চারজনকে–সুধীরবাবুদের, সেন সাহেবকে, বালিগঞ্জ পার্কের মিঃ নেওটিয়াকে। সবাই গিয়ে দর্শন করে এসেছেন। আর দুটো দিন যাক না, দেখুন কী হয়! আসল স্টারের অ্যাট্রাকশনটা কোথায় সেটা বুঝতে পারবেন।