অভিও কোনওমতে উঠে সর্বনাশ বলে ছুটল বাদশার পিছনে।
আমি গুলিভরা বন্দুক নিয়ে কারখানা-ঘরের দিকে ছুটে গিয়ে দেখি, বাদশা এক বিরাট লাফে একমাত্র খোলা জানলার উপর উঠল এবং অভির বাধা দেবার শেষ চেষ্টা ব্যর্থ করে ঘরের ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
কান্তিবাবু চাবি দিয়ে দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই শুনতে পেলাম রামপুর হাউন্ডের মর্মান্তিক আর্তনাদ।
ঢুকে দেখি–এক শুঁড়ে শানাচ্ছে না; একের পর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শুঁড় দিয়ে সেপ্টোপাস্ বাদশাকে মরণপাশে আবদ্ধ করেছে।
কান্তিবাবু চিৎকার করে বলে উঠলেন, তোমরা আর এগিও না! পরিমল, চালাও গুলি!
বন্দুক উঁচিয়েছি এমন সময় চিৎকার এল, থামো।
অভিজিতের কাছে তার কুকুরের মূল্য কতখানি তা এবার বুঝতে পারলাম। সে কান্তিবাবুর বারণ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ছুটে গিয়ে সেপ্টোপা-এর তিনটে শুড়ের একটাকে আঁকড়ে ধরল।
তখন এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখে আমার রক্ত জল হয়ে গেল।
তিনটে শুঁড়ই একসঙ্গে বাদশাকে ছেড়ে দিয়ে অভিকে আক্রমণ করল। আর অন্য চারটে শুঁড় যেন মানুষের রক্তের লোভেই হঠাৎ সজাগ হয়ে লোলুপ জিহ্বার মতো লকলক করে উঠল।
কান্তিবাবু আবার বললেন, চালাও–চালাও গুলি! ওই যে মাথা।
সেপ্টোপাস-এর মাথায় দেখলাম একটা ঢাকনি আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। ঢাকনির নীচে গহ্বর। আর অভিসমেত শুঁড়গুলি শূন্যে উঠে সেই গহ্বরের দিকে চলেছে।
অভির মুখ রক্তহীন ফ্যাকাশে, তার চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে।
চরম সংকটের মুহূর্তে–আমি এর আগেও দেখেছি–আমার স্নায়ুগুলো সব যেন হঠাৎ কেমন ম্যাজিকের মতো সংযত, সংহত হয়ে যায়।
আমি নিষ্কম্প হাতে বন্দুক নিয়ে সেপ্টোপা-এর মাথার দুটি চক্রের মধ্যিখানে অব্যর্থ নিশানায় গুলি ছুড়লাম।
ছোঁড়ার পরমুহূর্তেই, মনে আছে, ফিনকি দিয়ে গাছের মাথা থেকে লাল রক্তের ফোয়ারা। আর মনে আছে, শুঁড়গুলো অভিকে মুক্তি দিয়ে মাটিতে নেতিয়ে পড়ছে, আর সেইসঙ্গে আগের সেই গন্ধটা হঠাৎ তীব্রভাবে বেড়ে উঠে আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন, অবশ করছে।…
.
আগের ঘটনার পর চার মাস কেটে গেছে। এতদিনে আবার আমার অসমাপ্ত উপন্যাসটা নিয়ে পড়েছি।
বাদশাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। তবে অভি ইতিমধ্যে একটি ম্যাস্টিফ ও একটি তিব্বতী কুকুরের বাচ্চা সংগ্রহ করেছে এবং আরেকটি রামপুর হাউন্ডের সন্ধান করছে। অভির পাঁজরের দুখানা হাড় ভেঙেছিল। দুমাস প্লাস্টারে থাকার পর জোড়া লেগেছে।
কান্তিবাবু কাল এসেছিলেন। বললেন কীটখোর গাছপালা সব বিদেয় করে দেবার কথা ভাবছেন।
বরং সাধারণ শাক-সবজি নিয়ে একটু গবেষণা করলে ভাল হয়। ঝিঙে, উচ্ছে, পটল–এইসব আর কি! যদি বলো, তোমায় কিছু গাছ দিতে পারি। তুমি আমার এত উপকার করলে! এই ধরো একটা নেপেনথি তোমার ঘরের পোকাগুলোকে অন্তত–
আমি বাধা দিয়ে বললাম, না না। ওসব আপনি ফেলে দিতে চান তো ফেলে দিন। পোকা ধরার জন্য আমার গাছের দরকার নেই।
কিং কোম্পানির ক্যালেন্ডারের পিছন দিক থেকে শব্দ এল, ঠিক ঠিক ঠিক।
সন্দেশ, বৈশাখ ১৩৬৯