আমি তাই প্রথম সুযোগেই নিকারাগুয়ার দিকে চলে যাই। গুয়াটেমালা থেকেই স্থানীয় লোকের কাছে এ গাছের বর্ণনা শুনতে থাকি। তারা বলে শয়তান গাছ। শেষটায় অবিশ্যি এমন গাছ একাধিক চোখে পড়ে। বাঁদর, আরমাডিলো, অনেক কিছু খেতে দেখেছি এ গাছকে। অনেক খোঁজার পর একটা অল্পবয়স্ক ছোটখাটো চারাগাছ পেয়ে সেটাকে তুলে আনি। দুবছরে গাছের কী সাইজ হয়েছে দেখতেই পাচ্ছ।
এখন কী খায় গাছটা?
যা দিই তাই খায়। কলে ইঁদুর ধরে খেতে দিয়েছি। তারপর প্রয়াগকে বলে দিয়েছিলাম–বেড়াল কুকুর চাপা পড়লে ধরে আনতে, তাও দিয়েছি। তারপর তুমি আমি যা খাই তাও দিয়েছি–অর্থাৎ মুরগি, ছাগল। ইদানীং খিদেটা খুব বেড়েছে। খাবার জুগিয়ে উঠতে পারছি না। বিকেলের দিকে ঘুম ভাঙার পর ভয়ানক ছটফট করে। কাল তো একটা কাণ্ডই হয়ে গেল। প্রয়াগ গিয়েছিল একটা মুরগি দিতে। হাতিকে যেভাবে খাওয়ায় সেভাবেই খাওয়াতে হয়। প্রথমে গাছটার মাথায় একটা ঢাকনা খুলে যায়। তারপর শুঁড় দিয়ে খাবারটা হাত থেকে নিয়ে মাথার গর্তের মধ্যে পুরে দেয়। একটা যে-কোনও খাবার পেটে পুরলে কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চিন্ত থাকা যায়। তারপর আবার শুঁড়গুলো দোলাতে আরম্ভ করলে বোঝা যায় যে, আরও খেতে চাইছে।
এতদিন দুটো মুরগি অথবা একটি কচি পাঁঠায় একদিনের খাওয়া হয়ে যেত। কাল থেকে তার ব্যতিক্রম হচ্ছে। কাল দ্বিতীয় মুরগিটা দিয়ে প্রয়াগ দরজা বন্ধ করে চলে এসেছিল। অস্থির অবস্থায় শুঁড়গুলো আছড়ালে একটা শব্দ হয়। দ্বিতীয় মুরগির পরেও হঠাৎ সেই আওয়াজটা পেয়ে প্রয়াগ গিয়েছিল অনুসন্ধান করতে।
আমি তখন ঘরে বসে ডায়রি লিখছি। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি সেপ্টোপা–এর একটি শুঁড় প্রয়াগের ডান হাতটা আঁকড়ে ধরেছে। প্রয়াগ প্রাণপণে সেটা টেনে ছাড়াবার চেষ্টা করছে, কিন্তু সেইসঙ্গে সেপ্টোপাস-এর আর একটি শুঁড় লকলক করে প্রয়াগের দিকে এগোচ্ছে।
আমি দৌড়ে গিয়ে আমার লাঠি দিয়ে শুঁড়টায় এক প্রচণ্ড আঘাত করে দুহাত দিয়ে প্রয়াগকে টেনে কোনওমতে তাকে উদ্ধার করি। তবে চিন্তার কারণ হচ্ছে এই যে, প্রয়াগের হাতের খানিকটা মাংস সেপ্টোপাস খাবলে নিয়েছিল, এবং সেটাই সে পেটের মধ্যে পুরেছে, এ আমার নিজের চোখে দেখা।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে বারান্দায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। কান্তিবাবু একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। তারপর পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, সেপ্টোপা-এর যে মানুষের প্রতি লোভ বা আক্রোশ থাকতে পারে তার কোনও ইঙ্গিত এতদিন পাইনি। কাল যখন পেলাম, তারপরে, এটাকে মেরে ফেলা ছাড়া আর কোনও উপায় দেখছি না। কাল একবার খাবারে বিষ মিশিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কী আশ্চর্য বুদ্ধি গাছটার–সে-খাবার ও অঁড়ে নিয়েই ফেলে দিল। একমাত্র উপায় হল গুলি করে মারা। পরিমল, তোমায় কেন ডেকেছি সেটা বুঝতে পারছ তো!
আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, গুলি করলে ও মরবে কিনা সেটা আপনি জানেন?
কান্তিবাবু বললেন, মরবে কিনা জানি না। তবে আমার বিশ্বাস, ব্রেন বলে ওর একটা জিনিস আছে। ওর চিন্তাশক্তি যে আছে তার তো প্রমাণই পেয়েছি, কারণ আমি তো কতবার ওর কত কাছে গেছি–ও তো আমাকে কোনওদিন আক্রমণ করেনি। আমাকে চেনে–যেমন কুকুর তার মনিবকে চেনে। প্রয়াগের উপর আক্রোশের কারণ হচ্ছে যে, প্রয়াগ কয়েকবার ওর সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করার চেষ্টা করেছে। খাবারের লোভ দেখিয়ে, দেয়নি; কিংবা শুড়ের ডগার কাছে নিয়ে গিয়ে আবার পিছিয়ে নিয়েছে। মস্তিষ্ক ওর আছেই, এবং আমার বিশ্বাস, সেটা যেখানে থাকার কথা সেখানেই আছে–অর্থাৎ ওর মাথায়। যেখানে ঘিরে শুঁড়গুলো বেরিয়েছে সেখানেই তোমায় তাগ করে গুলি ওর মাথাতেই মারতে হবে।
অভি ফস করে বলল, সে আর এমন কী! সে তো এক মিনিটের মধ্যেই পরীক্ষা করে দেখা যায়। পরিমল, তোর বন্দুকটা–
কান্তিবাবু হাত তুলে অভিকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, শিকার যদি ঘুমিয়ে থাকে, তখন কি তাকে মারা চলে? পরিমলের হান্টিং কোড কী বলে?
আমি বললাম, ঘুমন্ত শিকারকে গুলি করা একেবারেই নীতিবিরুদ্ধ। বিশেষত শিকার যেখানে চলেফিরে বেড়াতে পারে না, সেখানে তো এ প্রশ্ন উঠতেই পারে না।
কান্তিবাবু ফ্লাস্কে এনে চা পরিবেশন করলেন। চা-পান শেষ হতে না হতে মিনিট পনেরোর মধ্যেই সেপ্টোপাসের ঘুম ভাঙল।
বাদশা পাশের ঘরে কিছুক্ষণ থেকেই উসখুস করছিল। হঠাৎ একটা খচমচ আর গোঙানির শব্দ পেয়ে অভি আর আমি উঠে গিয়ে দেখি বাদশা দাঁত দিয়ে প্রাণপণে তার বকলসটাকে হেঁড়বার চেষ্টা করছে। অভি ধমক দিয়ে বাদশাকে নিরস্ত করতে গেছে, এমন সময় কারখানা-ঘর থেকে একটা সপাত শব্দ আর তার সঙ্গে একটা উগ্র গন্ধ পেলাম। গন্ধটা এমন, যার তুলনা দেওয়া মুশকিল। ছেলেবেলায় টনসিল অপারেশনের সময় ক্লোরোফর্ম শুকতে হয়েছিল, তার সঙ্গে হয়তো কিছুটা মিল আছে।
কান্তিবাবু হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বললেন, চলো, সময় হয়েছে।
আমি বললাম, গন্ধটা কীসের?
সেপ্টোপাস-এর। এই গন্ধ ছড়িয়েই ওরা শিকার–
কান্তিবাবুর কথা শেষ হল না। বাদশা প্রচণ্ড এক টানে বক্লস ছিঁড়ে ধাক্কার চোটে অভিকে উলটিয়ে ফেলে তীরবেগে পাগলের মতো ছুটল ওই গন্ধের উৎসের দিকে।