আমি অবাক বিস্ময়ে উচ্চিংড়ের দশা দেখছিলাম। প্রথমে কিছুক্ষণ ছটফট করেছিল। এখন দেখলাম একেবারে নির্জীব। আর দেখলাম যে পাতার চাপ ক্রমশ বাড়ছে। টিকটিকির চেয়ে এ গাছ কম হিংস্র কীসে?
অভি কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, এঃ–এমন গাছ একটা বাড়িতে থাকলে তো পোকামাকড়ের উৎপাত থেকে অনেকটা রেহাই পাওয়া যেত। আরশোলার জন্য আর ডি-ডি-টি পাউডার ছড়াতে হত না।
কান্তিবাবু বললেন, এ গাছ আরশোলা হজম করতে পারবে না। তা ছাড়া এর পাতার আয়তনও ছোট। আরশোলার জন্য অন্য গাছ। এই যে–এদিকে।
পাশের বাক্সের সামনে গিয়ে দেখি লিলির মতো বড় বড় লম্বা পাতাওয়ালা একটা গাছ। প্রত্যেকটা পাতার ডগা থেকে একটি করে ঢাকনা সমেত থলির মতো জিনিস ঝুলছে। এটার ছবি মনে ছিল, তাই আর চিনিয়ে দিতে হল না।
কান্তিবাবু বললেন, এই হল নেপেন্থিস্ বা পিচার প্ল্যান্ট। এর খাঁই অনেক বেশি। প্রথম যখন গাছটি পাই তখন ওই থলির মধ্যে একটা ছোট্ট পাখিকে ছিবড়ে অবস্থায় পেয়েছিলাম।
বাপরে বাপ! অভির তাচ্ছিল্যের ভাব ক্রমশই অন্তর্হিত হচ্ছিল। এখন ওটা কী খায়?
আরশোলা, প্রজাপতি, শুয়োপোকা–এইসব আর কি! মাঝে আমার কলে একটা ইঁদুর ধরা পড়েছিল। সেটাও খাইয়ে দেখেছিলাম, আপত্তি করেনি। তবে গুরুপাকের ফলে এসব গাছ অনেক সময়ে মরে যায়। অত্যন্ত লোভী তো! কোন অবধি ভোজন সইবে সেটা নিজেরাই আন্দাজ করতে পারে না।
ক্রমবর্ধমান বিস্ময়ে এবাক্স থেকে ওবাক্স ঘুরে গাছগুলো দেখতে লাগলাম। বাটারওয়ার্ট, সানডিউ, ব্ল্যাডারওয়ার্ট, অ্যারজিয়া–এগুলোর ছবি আগে দেখেছি। তাই মোটামুটি চিনতেও পারলাম। কিন্তু অন্যগুলো একেবারে নতুন, একেবারে তাজ্জব, একেবারে অবিশ্বাস্য। প্রায় বিশ রকমের মাংসাশী গাছ কান্তিবাবু সংগ্রহ করেছেন, তার কোনও-কোনওটা পৃথিবীর অন্য কোনও কালেকশনেই নাকি নেই।
এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর গাছ যেটি–সানডিউ–তার ছোট্ট পাতাগুলোর চারপাশে সরু লম্বা লম্বা রোঁয়ার ডগায় জলবিন্দু চকচক করছে।
কান্তিবাবু একটি সুতোর ডগায় এলাচের দানার সাইজের একটুকরো মাংস ঝুলিয়ে সুতোটাকে আস্তে আস্তে পাতাটির কাছে নিয়ে যেতে খালি চোখেই দেখতে পেলাম, রোঁয়াগুলো সব একসঙ্গে লুব্ধ ভঙ্গিতে মাংসখণ্ডটার দিকে উঁচিয়ে উঠল।
হাতটা সরিয়ে নিয়ে কান্তিবাবু বললেন, মাংসটা পেলে পাতাটা Fly Trap-এর মতোই ওটাকে জাপটে ধরে নিত। তারপর পুষ্টিকর যা-কিছু শুষে নিয়ে অকেজো ছিবড়েটাকে ফেলে দিত। তোমার-আমার খাওয়ার সঙ্গে কোনও তফাত নেই, কী বলে?
আমরা শেড থেকে বেরিয়ে বাগানে এলাম।
শিরীষ গাছের ছায়াটা লম্বা হয়ে বাগানের উপর পড়েছে। ঘড়িতে দেখলাম চারটে বাজে।
কান্তিবাবু বললেন, এর অধিকাংশ গাছের কথাই তোমার বটানির বইয়ে পাবে। তবে আমার যেটি সবচেয়ে আশ্চর্য সংগ্রহ, সেটির কথা আমি না লিখলে কোনও বইয়ে থাকবে না। সেটির জন্যই আজ তোমাদের এখানে আসতে বলা। চলো পরিমল। চলুন অভিজিৎবাবু।
কান্তিবাবুর পিছন পিছন এবার আমরা বড় কারখানা-ঘরটার দিকে এগোলাম।
টিনের দরজাটা তালা দিয়ে বন্ধ। দুদিকে দুটো জানলা রয়েছে। তারই একটা হাত দিয়ে ঠেলে খুলে নিজে উঁকি মেরে আমাদের বললেন, দেখো।
অভি আর আমি জানলায় মুখ লাগালাম।
ঘরের পশ্চিম দিকের দেয়ালের উপর দিকের দুটো কাঁচের জানলা যা স্কাইলাইট দিয়ে রোদ আসায় ভিতরটা কিছু আলো হয়েছে।
ঘরের মধ্যে যে জিনিসটা রয়েছে, হঠাৎ দেখলে সেটাকে গাছ বলে মনে হওয়ার কথা নয়। বরং একাধিক শুঁড়বিশিষ্ট কোনও আজব জানোয়ার বলে মনে হতে পারে। ভাল করে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, গুঁড়ি একটা আছে। সেটা পাঁচ-ছ হাত উঠে একটা মাথায় শেষ হয়েছে, এবং সেই মাথার হাতখানেক নীচে মাথাটাকে গোল করে ঘিরে কতগুলো শুড়ের উৎপত্তি হয়েছে। গুনে দেখি সাতটা শুঁড়।
গাছের গা পাংশুটে মসৃণ, এবং সর্বাঙ্গে ব্রাউন চাকা চাকা দাগ।
শুঁড়গুলো আপাতত মাটিতে নুয়ে পড়ে আছে। কেমন যেন নির্জীব ভাব। কিন্তু তাও গা-টা ছমছম করে উঠল।
অন্ধকারে চোখটা অভ্যস্ত হলে আরও একটা জিনিস লক্ষ করলাম। ঘরের মেঝেতে গাছের চারিদিকে পাখির পালক ছড়িয়ে আছে।
কতক্ষণ চুপ করে ছিলাম জানি না। কান্তিবাবুর গলার স্বরে আবার যেন সংবিৎ ফিরে পেলাম।
গাছটা এখন ঘুমোচ্ছে। ওঠবার সময় হল বলে।
অভি অবিশ্বাসের সুরে বলল, ওটা কি সত্যিই গাছ?
কান্তিবাবু বললেন, মাটি থেকে গজাচ্ছে যখন, তখন গাছ ছাড়া আর কী বলবেন বলুন! হাবভাব। অবিশ্যি গাছের মতো নয়। অভিধানে এর উপযুক্ত কোনও নাম নেই।
আপনি কী বলেন?
সেপ্টোপাস। অথবা বাংলায় সপ্তপাশ। পাশ–অর্থাৎ বন্ধন; যেমন নাগপাশ।
আমরা বাড়ির দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। বললাম, এ গাছ পেলেন কোথায়?
মধ্য আমেরিকার নিকারাগুয়া হ্রদের কাছেই গভীর জঙ্গল আছে; তার ভিতরে।
অনেক খুঁজতে হয়েছে বলুন?
ওই অঞ্চলেই যে আছে সেটা জানা ছিল। তোমরা বোধহয় প্রোফেসর ডানস্টান-এর কথা শোনননি? উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও পর্যটক ছিলেন। মধ্য আমেরিকায় গাছপালার সন্ধান করতে গিয়ে প্রাণ হারান। ঠিক কীভাবে তাঁর মৃত্যু হয় কেউ জানতে পারেনি; মৃতদেহ সম্পূর্ণ নিখোঁজ হয়ে যায়। তাঁর তৎকালীন ডায়রির শেষের দিকে এ গাছটার উল্লেখ পাওয়া যায়।