কান্তিবাবুর বাড়ি খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধে হল না। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় আড়াইটে। গেটের ভিতর দিয়ে ঢুকে খানিকটা রাস্তা গিয়ে একতলা বাংলো-ধাঁচের বাড়ি। বাড়ির পিছনদিকে কিছুটা জায়গা ছেড়ে একটা প্রকাণ্ড পুরনো শিরীষ গাছ এবং তার পাশেই বেশ বড় একটা কারখানা গোছের টিনের ছাতওয়ালা ঘর। বাড়ির মুখোমুখি রাস্তার উলটোদিকে বাগান এবং বাগানের পরে একটা লম্বা টিনের ছাউনি দেওয়া জায়গায় চকচক করছে একসারি কাঁচের বাক্স।
কান্তিবাবু আমাদের অভ্যর্থনা করে বাদশাকে দেখে ঈষৎ কুঞ্চিত করলেন। বললেন, এ কি শিক্ষিত কুকুর?
অভি বলল, আমার খুব বাধ্য। তবে কাছাকাছি অন্য শিক্ষিত কুকুর থাকলে কী করবে বলা যায় না। আপনার এখানে কোনও কুকুর-টুকুর…?
না। কুকুর নেই। তবে ওটাকে আপাতত বসবার ঘরের ওই জানলাটার গরাদটায় বেঁধে রাখুন।
অভিজিৎ আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে চোখ টিপে বাধ্য ছেলের মতো কুকুরটাকে জানলার সঙ্গে বেঁধে দিল। বাদশা দু-একটা মৃদু আপত্তি জানিয়ে আর কিছু বলল না।
আমরা সামনের বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসার পর কান্তিবাবু বললেন, আমার চাকর প্রয়াগের ডান হাত জখম, তাই আমি নিজেই সকাল সকাল তোমাদের জন্য ফ্লাস্কে চা করে রেখেছি। যখন দরকার হয় বোলো।
এই শান্ত নিরিবিলি জায়গায় কী বিপদ লুকিয়ে থাকতে পারে সেটা আমার মাথায় আসছিল না। দু একটা পাখির ডাক ছাড়া আর তো কোনও শব্দই নেই। বন্দুকটা হাতে নিয়ে কেমন বোকা-বোকা লাগছিল নিজেকে, তাই সেটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেখে দিলাম।
অভি ছটফটে মানুষ–নেহাতই শহুরে। গ্রামাঞ্চলের প্রাকৃতিক শোভা, অশথপাতার হাওয়ার ঝিরঝির শব্দ, নাম-না-জানা পাখির ডাক–এসব তার মোটেই ধাতে সয় না। সে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক চেয়ে উসখুস করে বলে উঠল, পরিমলের কাছে শুনছিলাম আপনি নাকি আসামের জঙ্গলে এক বিদঘুঁটে গাছ সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রায় বাঘের খপ্পরে পড়েছিলেন?
অভির অভ্যাসই হল রঙ চড়িয়ে নাটকীয়ভাবে কথা বলা। ভয় হল কান্তিবাবু বুঝি ফস করে রেগে ওঠেন। কিন্তু ভদ্রলোক কেবল হেসে বললেন, বিপদ বলতেই আপনাদের বাঘের কথা মনে হয়, না? সেটা অবিশ্যি আশ্চর্য নয়। অধিকাংশের তাই। তবেনা। বাঘের কবলে পড়িনি। জোঁকের হাতে কিছুটা নাকাল হতে হয়েছিল বটে, তাও তেমন কিছু নয়।
সে গাছ পেয়েছিলেন?
এ প্রশ্নটা আমারও মাথায় ঘুরছিল।
কান্তিবাবু বললেন, কোন গাছ?
সেই যে হাঁড়ি কলসি না কী গাছ জানি…
ও। নেপেন্থিস্। হ্যাঁ, পেয়েছিলাম। এখনও আছে। দেখাচ্ছি আপনাদের। এখন আর অন্য কোনও গাছে তেমন ইন্টারেস্ট নেই। কেবল কার্নিভোরাস প্লান্টস। অর্কিডগুলোও অধিকাংশই বিদেয় করে দিয়েছি।
কান্তিবাবু উঠে ঘরের ভিতরে চলে গেলেন।
আমি আর অভি মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। কার্নিভোরা প্লান্টস–অর্থাৎ মাংসাশী গাছ। পনেরো বছর আগে পড়া বটানির বইয়ের একটি পাতা ও কয়েকটি ছবি আবছাভাবে মনে পড়ে গেল।
কান্তিবাবু বেরোলেন হাতে একটি বোতল নিয়ে। বোতলটা আমাদের সামনে ধরতে দেখলাম, তাতে উচ্চিংড়ে জাতীয় নানান সাইজের সব পোকা ঘঘারাফেরা করছে। বোতলের ঢাকনায় গোলমরিচদানের ঢাকনার মতো ছোট ছোট ফুটো।
কান্তিবাবু হেসে বললেন, ফিডিং টাইম। এসো আমার সঙ্গে।
.
আমরা কান্তিবাবুর পিছন পিছন টিনের ছাউনি দেওয়া লম্বা ঘরটার দিকে গেলাম।
গিয়ে দেখি সারবাঁধা কাঁচের বাক্সগুলোর মধ্যে এক-একটায় এক-একরকম গাছ; তার কোনওটাই এর আগে চোখে দেখিনি।
কান্তিবাবু বললেন, এর কোনওটাই বাংলাদেশে পাবে না–অবিশ্যি ওই নেপেনথিস ছাড়া। একটা আছে নেপাল থেকে আনানো। একটা আফ্রিকার। অন্য সবকটাই প্রায় মধ্য আমেরিকার।
অভিজিৎ বলল, এসব গাছ এখানে বেঁচে রয়েছে কী করে? এখানকার মাটিতে কি–?
মাটির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই এদের।
তবে?
এরা মাটি থেকে প্রাণ সঞ্চয় করে না। মানুষ যেমন ঠিকমতো খাদ্য পেলে নিজের দেশের বাইরে অনেক জায়গাতেই স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকতে পারে–এরাও তেমনই ঠিকমতো খেতে পেলেই বেঁচে থাকে, সে যেখানেই হোক।
কান্তিবাবু একটা কাঁচের বাক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভিতরে এক আশ্চর্য গাছ। ইঞ্চি দুই লম্বা সবুজ পাতাগুলোর দুপাশে সাদা সাদা দাঁতের মতো খাঁজ-কাটা।
বাক্সটার সামনের দিকে কাঁচের গায়ে একটা ছিটকিনি-দেওয়া বোতলের মুখের সাইজের গোল দরজা। কান্তিবাবু দরজাটা খুললেন। তারপর বোতলের ঢাকনিটা খুলে ক্ষিপ্র হস্তে বোতলের মুখটা দরজার ভিতরে গলিয়ে দিলেন।
উচ্চিংডেটা এদিক-ওদিক লাফিয়ে গাছটার পাতার উপর বসল, এবং বসতেই তৎক্ষণাৎ পাতাটা মাঝখান থেকে ভাঁজ হয়ে গিয়ে পোকাটাকে জাপটে ধরল। অবাক হয়ে দেখলাম যে, দুদিকের দাঁত পরস্পরের খাঁজে খাঁজে বসে যাওয়ায় এমন একটি খাঁচার সৃষ্টি হয়েছে, যার থেকে উচ্চিংড়ে বাবাজির আর বেরোবার কোনও রাস্তাই নেই।
প্রকৃতির এমন তাজ্জব, এমন বীভৎস ফাঁদ আমি আর কখনও দেখিনি।
অভি ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল, পোকাটা যে ওই পাতাটাতেই বসবে তার কোনও গ্যারান্টি আছে কি?
কান্তিবাবু বললেন, আছে বইকী! গাছগুলো থেকে এমন একটা গন্ধ বেরোয় যেটা পোকা অ্যাট্রাক্ট করে। এটা হল Venus Fly Trap৷ মধ্য আমেরিকা থেকে আনা। বটানির বইয়েতে এর কথা পাবে।