এইসব ভাবতে ভাবতেই শ্রীমতীর মনে পড়ল যে, আসছে মাসে তার বিয়ে। যাকে সে বিয়ে করবে, সেই যুবরাজ রণবীর কথা দিয়েছে যে, শ্রীমতীর পড়াশুনার ব্যবস্থা তার বাড়িতেও হবে। আর তার জন্য অন্দরমহলের ভিতরে একটা ঘর রাখবে যাতে সূর্যের আলো কখনও প্রবেশ না করে। আলো লেগে রাজকন্যার রঙ যদি কালো হয়ে যায়!
সুজন কিন্তু রাজকন্যাকে দেখতে পায়নি। রাজা তাকে একটা হাতে আঁকা ছবি দেখিয়ে বলেছেন, এই দেখ আমার মেয়ের চেহারা। ছবি দেখেই সুজনের মনে হয়েছে এ যেন স্বর্গের অপ্সরী। তারপর সুজন যখন শুনল যে, রাজকন্যা তার হরবোলার ডাক শুনে মোহিত হয়ে গেছে, তখন গর্বে তার বুকটা ভরে উঠল। আর তা ছাড়া রাজামশাই ইনামও দিয়েছেন ভাল; একটা হিরের আংটি আর একশত স্বর্ণমুদ্রা। সুজন জানে, এই টাকায় তাদের বাকি জীবনটা স্বচ্ছন্দে চলে যাবে।
কেবল একটা কথা ভেবে তার বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। ওই রাক্ষসটাকে যদি শায়েস্তা করা যেত!
.
০৪.
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল। এর মধ্যে সুজন বেশ কয়েকবার কাছাকাছির মধ্যে অন্য শহরে গিয়ে হরবোলার খেলা দেখিয়ে আরও কিছু রোজগার করে নিয়েছে, আর সে রোজগারের প্রায় সবটুকুই সে দেশে গিয়ে তার বাপের হাতে তুলে দিয়েছে। সে বেশ বুঝতে পারছে যে তার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। যেটুকু সময় সে রাজবাড়িতে থাকে, তার অনেকটাই সে নতুন নতুন ডাক অভ্যাস করে কাটিয়ে দেয়। একথা সে কখনওই ভুলতে পারে না যে, সামনে বিয়ের সভায় তাকে খেলা দেখাতে হবে, জবরনগরের রাজার সুনাম তাকে রাখতে হবে।
যদিও বিয়ের ধুমধাম শুরু হয়ে গেছে, রাজকন্যা শ্ৰীমতীর মনের অবস্থা কী তা কেউ জানে না। তার জীবনটা যেমন চাপা, তার মনটাও তেমনই চাপা। তবে এটা ঠিক যে, গত এক মাসে তাকে হাসতে দেখেনি কেউ। সুজন প্রাসাদের নীচের ঘরে পাখির ডাক অভ্যাস করে, তার সামান্য কিছুটা শব্দ ভেসে আসে দোতলায় অন্দরমহলের এই অংশে। সেই ক্ষীণ শব্দ শুনে শ্রীমতীর মনটা দুলে ওঠে। আশ্চর্য গুণ এই যুবকের! না জানি কথাবার্তায় সে কেমন!
এই কৌতূহল এক মাসে চরমে পৌঁছে গেছে। যে এমন সব ডাক ডাকতে পারে, যে এমন সুপুরুষ অথচ সরল, সে তোক কেমন সেটা শ্ৰীমতীকে জানতে হবেই। সে একদিন সুরধুনীকে কথাটা বলেই ফেলল।
.
সুরধুনী আজ পাঁচ বছর ধরে শ্রীমতীর সখী। শ্রীমতীকে যে ঘরে বন্ধ করে রাখা হয় সেটা সুরধুনী পছন্দ করে না। সে শ্ৰীমতীর কাছে বর্ণনা দেয় সকালের ফুটফুটে রোদে গাছপালা নদনদী মাঠঘাটের। পাখি কেমন জিনিস সে এককালে দেখেছে, সে কথাও সে বলল।
তোকে ভাই একটা কাজ করতেই হবে, শ্ৰীমতী বলল।
কী কাজ?
সেই হরবোলার ঘরে যাবার রাস্তাটা জেনে নিতে হবে।
সুরধুনী কথা দিল সে জেনে দেবে। আর তারপর সত্যিই একদিন অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে প্রহরীকে শ্ৰীমতীর কাছ থেকে নেওয়া একটা মোহর ঘুষ দিয়ে সে নীচে এসে দেখে গেল সুজনের ঘর। সুজন তখন বসন্তবৌরীর ডাক অভ্যাস করছে।
সেই রাত্রে সুজন যখন খাওয়া-দাওয়া করে বিছানায় উঠতে যাবে তখন সুরধুনী এল তার ঘরে।
এ কী! বলে উঠল সুজন।
সুরধুনী ঠোঁটে আঙুল দিল। তারপর ইশারা করে ঘরে ডেকে নিল শ্রীমতীকে।
তুমি! অবাক হয়ে বলল সুজন। তোমার ছবি আমি দেখেছি!
তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম, ধীর কণ্ঠে বলল শ্রীমতী। তুমি আমার সামনে নতুন জগৎ খুলে দিয়েছ।
কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে কী কথা বলব? আমার তো বিদ্যে বুদ্ধি নেই। আমি পাঁচের নামতাও বলতে পারি না, আর তুমি শুনেছি অনেক লেখাপড়া করেছ। তাই–
তুমি সূর্য দেখেছ?
হ্যাঁ। রোজ দেখি। সূর্য যখন ওঠে, তখন আকাশে সিদুর লেপে দেয়। আবার যখন ডোবে, তখনও। সূর্য ওঠার আগেই পাখিরা গান শুরু করে। সূর্য ডুবলেই তারা তাদের বাসায় চলে যায়।
বসন্তের ফুল দেখেছ তুমি?
হ্যাঁ। এখনও দেখি। রোজই দেখি। লাল নীল হলদে সাদা বেগুনি কত রঙ! মৌমাছি এসে মধু খায়, প্রজাপতি উড়ে বেড়ায় ফুলের ধারে ধারে। কুঁড়ি থেকে ফুল হয়। সে ফুটে আবার ঝরে পড়ে। গাছের পাতায় বসন্তে কচি রঙ ধরে, শীতে সে পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ে।
একটা কথা ভেবে বড় কষ্ট হয়। কী কথা? পাখিরা এত সুন্দর গান গায়, কিন্তু এখন সেসব পাখি চলে গেছে ওই রাক্ষসের পেটে। তাকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমার কিছুই ভাল লাগছে না।
কিন্তু তোমার যে সামনে বিয়ে। এখন ভাল না লাগলে চলবে কী করে? বিয়েতে কত আনন্দ! আমিও তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু তোমার মুখে পাখির গান শোনার পর থেকে আর আনন্দ নেই। আমি বাবাকে বলেছি।
কী বলেছ?
যার সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, সে যদি ওই রাক্ষসকে মারতে পারে, তবেই আমি তাকে বিয়ে করব। আমাকে বিয়ে করার শর্তই হবে ওই।
সে না মেরে যদি আর কেউ মারে?
যে মারবে তাকেই আমি বিয়ে করব। যার শক্তি নেই সে মানুষই নয়।
তুমি খুব কঠিন শর্ত করেছ।
একথা কেন বলছ?
আমি সেই রাক্ষসের গুহায় গিয়েছিলাম। তার এক ডাকে আমি পালিয়ে এসেছি। সে বড় ভয়ানক ডাক।
শুনে আমি খুব দুঃখ পেলাম। আমি ভেবেছিলাম তুমি এত বাঘ ভাল্লুকের ডাক ডাকলে, তোমার বুঝি সাহস আছে। যাই হোক, যে এই বিহঙ্গভুকে মারতে পারবে আমি তাকেই বিয়ে করব।
এর নাম বিহঙ্গভু বুঝি?
হ্যাঁ।
তুমি কী করে জানলে?