রাত্তিরে খাবারও এল এমন যা সুজন কোনওদিন খায়নি। কত পদ, আর তাদের কী স্বাদ, কী গন্ধ! সবশেষে মিষ্টান্নই এল পাঁচ রকম। এত খাবে সে কী করে?
যতটা পারে তৃপ্তি করে খেয়ে সুজন ভাবতে বসল। সেই রাক্ষসের কথাটাই বারবার মনে পড়ছে তার। পাখির মতো এত সুন্দর জিনিস, আর সেই পাখিই এই রাক্ষস টপ টপ করে গিলে খায়? এমনই তার খিদে যে, শহরের সব পাখি সে শেষ করে ফেলেছে। একবার তার আস্তানাটা দেখে এলে হয় না? সুজনের এখনও ঘুম পায়নি। বাইরে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। পাহাড় কোনদিকে সে তো দেখাই আছে, শুধু গুহাটা কোথায় সেটা খুঁজে বার করা।
সুজন খাট থেকে উঠে পড়ল। তারপর দুগ্ন বলে বাইরে বেরিয়ে পড়ল। তাকে সকলেই চিনে গেছে, কাজেই ফটকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না।
চারিদিকে ফুটফুটে চাঁদের আলো, সুজন তারই মধ্যে সটান চলল আকাশি পাহাড় লক্ষ্য করে। অল্প কুয়াশায় পাহাড়টাকে মনে হয় ঝাঁপসা।
নিঝুম শহর দিয়ে দেড় ঘণ্টা হেঁটে সুজন গিয়ে পৌঁছল পাহাড়ের তলায়। চারিদিকে জনমানব নেই, রাতের প্যাঁচাও বোধহয় গেছে রাক্ষসের পেটে।
পাহাড়ের পাশ ধরে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিকটা পৌঁছতেই সুজন দেখতে পেল মাটি থেকে ত্রিশ-চল্লিশ হাত উপরে একটা অন্ধকার গুহা।
এটাই নিশ্চয় সেই রাক্ষসের গুহা। মানুষও কি এই রাক্ষসের খাদ্য নাকি? আশা করি নয়।
সুজন সাহস করে পাহাড় বেয়ে উঠে গেল।
এই যে গুহার মুখ। পাহাড়ের উলটো দিকে চাঁদ, তাই গুহার ভিতরে মিশকালো অন্ধকার।
সুজনের মনে রাগ থেকে কেমন যেন একটা সাহস এসেছে। পাখিরা তার বন্ধু; আর সেই বন্ধুরা যাচ্ছে এই রাক্ষসের পেটে, তাই এ রাগ।
সুজন অন্ধকার গুহার ভিতরটায় গিয়ে ঢুকল।
দশ পা ভিতরে যেতেই তাকে সেই দশ পা-ই ছিটকে বেরিয়ে আসতে হল।
গুহার ভিতর থেকে একটা ভয়ংকর হুঙ্কার শোনা গেছে। এমন বীভৎস ডাক কোনও জানোয়ারের মুখ দিয়ে বেরোয় না।
এটা রাক্ষস, আর রাক্ষস সুজনকে দেখেছে, আর দেখে মোটেই পছন্দ করেনি।
.
০৩.
সুজন এই ঘটনার পর আর সময় নষ্ট না করে প্রাসাদে তার ঘরে ফিরে এসেছিল। পরদিন সকালে একজন কর্মচারী এসে তাকে রাজার সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে গেল। রাজা এখনও সভায় যাননি। আগে তাঁর মেয়েকে শোনাবেন সুজনের পাখি আর জানোয়ারের ডাক, তারপর রাজকার্য। সুজন বুঝল, মেয়ের। উপর রাজার কত টান।
এদিকে রাজকন্যা শ্রীমতী কাল রাত্রেই শুনেছে সুজনের কথা কীভাবে বাঘের ডাক ডেকে সে জঙ্গলে বাঘ আছে প্রমাণ করে দিয়েছিল। শ্রীমতী বেড়াল ছাড়া কোনওদিন কোনও জানোয়ারের ডাক শোনেনি। পাখি যখন ছিল শহরে–আজ থেকে পাঁচ বছর আগে–তখনও সে তার হীরামন ছাড়া কোনও পাখির ডাক শোনেনি। ঘর থেকে সে বাইরেই বেরোত না, শুনবে কী করে? সে যে অসূর্যম্পশ্যা। যে সূর্যকে দেখেনি, তার তো প্রকৃতির সঙ্গে চোখের দেখাই হয়নি। অবিশ্যি বই পড়ে সে অনেক কিছুই জেনেছে, কিন্তু বইয়ে আর কত জানা যায়? চোখে দেখা আর কানে শোনায় যা হয়, শুধু বই পড়ে কি তা হয়? বাংলার পাখির নাম শ্রীমতীর মুখস্থ, কিন্তু সেসব পাখি কেমন ডাক ডাকে, কেমন গান গায়, তা সে কানে শোনেনি কখনও।
সুজন যখন গিয়ে অন্দরমহলের আঙিনায় পৌঁছাল, তখন শ্রীমতী তার ঘর থেকে আরেকটা ঘরে এসে বসেছে। এ-ঘরে একটা খোলা জানলা আছে, তাই দিয়ে আঙিনায় কোনও গান বাজনা হলে তার আওয়াজ শোনা যায়। সেই আঙিনাতেই এই হরবোলা তার কারসাজি দেখাবে।
দেউড়িতে আটটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই রাজামশাই সুজনকে বললেন, কই, শুরু কর এবার তোর খেলা। আমার মেয়ে উপরে বসে আছে, সে শুনতে পাবে।
কালটা বসন্ত, তাই সুজন পাপিয়া আর দোয়েলের ডাক দিয়ে শুরু করল। মানুষের গলায় এমন আশ্চর্য পাখির ডাক কেউ শোনেনি কখনও। পাঁচ বছর পরে এই প্রথম জবরনগরে পাখির ডাক শোনা গেল।
শুরুতেই রাজকন্যার চোখে জল এসে গেছে। চাপা স্বরে বলল শ্রীমতী, আহা কী সুন্দর! পাখি এমন করে ডাকে? আর এই পাখিরা সব গেছে সেই রাক্ষসের পেটে? কী অন্যায়! কী অন্যায়!
সুজন একটার পর একটা ডাক শুনিয়ে চলল। রাজার বুক গর্বে ভরে উঠল, আর রাজকন্যার প্রাণ ছটফট করতে লাগল। এমন যার ক্ষমতা, তাকে একবার চোখে দেখা যায় না?
ঘরের বাইরে বারান্দা, সে বারান্দা বাহারের কাপড় দিয়ে ঢাকা। সেই কাপড়ের এক পাশ ফাঁক করলে তবে নীচে দেখা যেতে পারে। রাজকন্যার পাশে তার সখী বসা, তাকে একবার ঘর থেকে সরানো দরকার। সুরধুনী, আমার জলতেষ্টা পেয়েছে, একটু খাবার জল এনে দে, বলল রাজকন্যা।
জল আনতে সেই শোয়ার ঘরে যেতে হবে, তাতে কিছুটা সময় যাবে।
সুরধুনী চলে গেল।
শ্ৰীমতী এক ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে এসে কাপড় ফাঁক করে দেখে নিল সেই ছেলেটিকে। সে এখন ফটিক-জলের ডাক ডাকছে। শ্ৰীমতীর দেখে বেশ ভাল লাগল ছেলেটিকে; তবে এটা সে বুঝল ছেলেটির পোশাকে যে, সে গরিব।
সুরধুনী জল নিয়ে আসার আগেই শ্রীমতী তার জায়গায় ফিরে এসেছে।
এক ঘণ্টা চলল সুজনের হরবোলার খেলা। এমন খেলা জবরনগরের রাজবাড়িতে কেউ কোনওদিন দেখেনি। আর রাজকন্যা তো এমন সব ডাক শোনেইনি; তার চোখের সামনে একটা নতুন জগৎ খুলে গেছে প্রকৃতির জগৎ, যার সঙ্গে এই যোনো বছরে তার কোনওদিন পরিচয়ই হয়নি। এই গরিব ঘরের ছেলেটি তার জীবনে একটা নতুন প্রাণ এনে দিয়েছে।