সুজন একটুক্ষণ ভাবল; তারপর বলল, বাঘ আছে, আর সে বাঘের ডাক আমি শুনিয়ে দিতে পারি, কিন্তু আপনি কি সে বাঘ মারবেন, রাজামশাই?
মারব না? শিকার মানেই তো জানোয়ার মারা।
কিন্তু বাঘ আপনার কী ক্ষতি করল যে, তাকে মারবেন?
রাজা আসলে খুব ভাল লোক ছিলেন। তিনি একটুক্ষণ গম্ভীর থেকে বললেন, বেশ, আমি তোর কথা মানলাম। বাঘ আমি মারব না, কারণ সত্যিই সে আমার কোনও অনিষ্ট করেনি। কিন্তু সে যে আছে তার প্রমাণ কই?
সুজন তখন দুহাত চোঙার মতন করে মুখের ওপর দিয়ে সামনের দিকে শরীরটাকে নুইয়ে একটা বড় দম নিয়ে ছাড়ল একটা হুঙ্কার। অবিকল বাঘের ডাক। আর তার এক পলক পরেই বনের ভিতর থেকে উত্তর এল, ঘ্যাঁয়াঁওঁ!
রাজা তো তাজ্জব!
তোর তো আশ্চর্য ক্ষমতা, বললেন রাজা। তুই থাকিস কোথায়?
আজ্ঞে, আমার গাঁয়ের নাম ক্ষীরা। এখান থেকে তিন ক্রোশ পথ।
তুই আমার সঙ্গে আমার রাজ্যে যাবি? তার নাম জবরনগর। এখান থেকে ত্রিশ ক্রোশ। আমার মেয়ের বিয়ে আছে সামনের মাসে আজবপুরের রাজকুমারের সঙ্গে। সেই বিয়েতে তুই হরবোলার ডাক শোনাবি। যাবি?
আজ্ঞে বাড়িতে যে বলতে হবে আগে।
তা সে তুই আজ বাড়ি চলে যা। আমরা বনে তাঁবু ফেলেছি। সেখানে রাত কাটিয়ে কাল সকালে ফিরব। তুই কাল সক্কাল সক্কাল চলে আসিস বাড়িতে বলে।
বেশ, তাই হবে।
.
০২.
সুজন বাড়ি ফিরে এসে মা-বাবাকে সব কথা বলল। দিবাকর তো মহাখুশি। বলল, এইবার ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন। তোর বোধ হয় একটা হিল্লে হল।
মা বলল, তুই যে যাবি, আর ফিরবি না নাকি?
পাগল! বলল সুজন। কাজ হয়ে গেলেই ফিরব। আর নাম-ডাক হলে মাঝে মাঝে বেরিয়ে যাব, মাঝে মাঝে ফিরব।
পরদিন ভোর থাকতে সুজন বেরিয়ে পড়ল। যখন চাঁড়ালির বনে পৌঁছল তখন সূর্য তালগাছের মাথা ছাড়িয়ে খানিকদূর উঠেছে। বনের ধারে একটু খুঁজতেই একটা খোলা জায়গায় জবরনগরের রাজার তাঁবু দেখতে পেল সুজন। রাজা দেশে ফিরে যাবার জন্য তৈরি হয়েই বসে আছেন। বললেন, তোকে একটা ঘোড়ায় তুলে নেবে আমার লোক, তুই তার সঙ্গেই যাবি!
সুজনকে আগে ভাল ভাল মিঠাই আর ফলমূল খেতে দিয়ে রাজা পাত্রমিত্র সঙ্গে করে রওনা দিলেন জবরনগর। ঘোড়ার পিঠে কোনওদিন চড়েনি সুজন, যদিও ঘোড়ার ডাক তার শেখা আছে। মহা আনন্দে রোদ থাকতে থাকতেই সুজন পৌঁছে গেল জবরনগর।
গাছপালা দালান-কোঠা পুকুর বাগান হাট বাজারে ভরা এমন বাহারের শহর সুজন কখনও দেখেনি। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করে তার ভারী আশ্চর্য লাগল। সে রাজাকে জিজ্ঞেস করল, এত গাছপালা, এত বাগান, তবু একটাও পাখির ডাক নেই কেন?
রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সে যে কতবড় দুঃখের কথা সে কী বলব তোকে! ওই যে দূরে পাহাড় দেখছিস, ওই পাহাড়ের নাম আকাশি। ওই পাহাড়ের গুহায় একটা রাক্ষস না থোক না জানোয়ার কী জানি এসে রয়েছে আজ পাঁচ বছর হল। তার খাদ্যই হল পাখি। সে যে কী জাদু করে তা জানি না, পাখিরা সব আপনা থেকে দলে দলে উড়ে গিয়ে তার গুহায় ঢোকে, আর রাক্ষসটা তাদের ধরে ধরে খায়। এখন এই শহরে আর কোনও পাখি বাকি নেই। কেবল একটা হীরামন আছে আমার মেয়ের খাঁচায়, রাজবাড়ির অন্দরমহলে।
কিন্তু তার খাবার ফুরিয়ে গেলে সে রাক্ষস বাঁচবে কী করে?
খাবার কি আর সে শুধু আমার শহর থেকে নেয়? পাহাড়ের উত্তরে আছে আজবপুর, পশ্চিমে আছে গোপালগড়–পাখির কি আর অভাব আছে?
এই জানোনায়ারকে কেউ দেখেনি কখনও?
না। সে গুহা থেকে বেরোয় না। আমি নিজে তীর-ধনুক নিয়ে গুহার মুখে অপেক্ষা করেছি, আর সঙ্গে সশস্ত্র সৈন্য ছিল পঞ্চাশজন। কিন্তু সে দেখা দেয়নি। গুহাটা অনেক গভীর; মশাল নিয়ে তার ভিতরে কিছুদূর গিয়েও তার দেখা পাইনি।
সুজন এমন অদ্ভুত ঘটনা কখনও শোনেনি। শুধু পাখি খায় এমন রাক্ষসও থাকতে পারে? আর তাকে কোনওমতেই শায়েস্তা করা যায় না, এ তো বড় আজব কথা!
ততক্ষণে রাজার দল প্রাসাদে পৌঁছে গেছে। রাজা বলল, প্রাসাদের একতলায় একটা ঘরে তুই থাকবি। কাল সকালে আমার মেয়েকে একবার শোনাবি তোর পাখি আর জানোয়ারের ডাক। আমার মেয়ের নাম শ্রীমতী। তার মতো বিদুষী মেয়ে আর ভূভারতে নেই। সে শাস্ত্র পড়েছে, ব্যাকরণ পড়েছে, ইতিহাস পড়েছে, গণিত পড়েছে, দেশবিদেশের রূপকথা সে জানে, রামায়ণ মহাভারত জানে। সে ঘরেই থেকেছে চিরটা কাল। সূর্যের আলো তার গায়ে লাগতে দিইনি, তার মতো দুধে-আলতায় রঙ আর কোনও মেয়ের নেই।
সুজন তো শুনে অবাক! মেয়েমানুষের এত বিদ্যেবুদ্ধি? আর সে নিজে যে অবিদ্যের জাহাজ! এই রাজকন্যার সঙ্গে তো কথাই বলা যাবে না।
এই রাজকন্যারই কি বিয়ে হবে? সে জিজ্ঞেস করল রাজাকে।
হ্যাঁ, এরই বিয়ে। আজবপুরের যুবরাজের সঙ্গে। সেও পণ্ডিত ছেলে, অনেক পড়াশুনো করেছে। রূপেগুণে সবদিক দিয়েই ভাল।
রাজপ্রাসাদে পৌঁছে সুজনকে তার ঘর দেখিয়ে দিল রাজার একজন পরিচারক। রাজামশাই বললেন, আজ বিশ্রাম কর, কাল সকালে তোকে এরা নিয়ে আসবে আমার কাছে। তারপর তোর গুণের পরীক্ষা হবে।
একটা কথা রাজামশাই। সুজন ওই পাখিখোর রাক্ষসের কথা তুলতেই পারছিল না।
কী কথা?
আকাশি পাহাড়টা এখান থেকে কতদূরে?
চার ক্রোশ পথ। কেন?
না, এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।
রাজা যে তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন সেটা সুজন তার ঘর দেখেই বুঝতে পারল। দিব্যি বড় ঘর, তাতে চমৎকার নকশা করা একটা পালঙ্ক, আর তা ছাড়াও আসবাব রয়েছে কাঠের আর শ্বেতপাথরের। পালঙ্কের বালিশের মতো বাহারের নরম বালিশ সুজন কখনও চোখেই দেখেনি, ব্যবহার করা তো দূরের কথা!