দিবাকর আর কী করে, ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, অ্যাদ্দিন পাঠশালায় গিয়ে কী শিখলি?
আমি বাইশ রকম পাখির ডাক শিখেছি, বাবা, বলল সুজন। আমাদের পাঠশালার পিছনে একটা বটগাছ আছে, তাতে অনেক রকম পাখি এসে বসে৷
তা তুই কি হরবোলা হবি নাকি? জিজ্ঞেস করল দিবাকর।
হরবোলা? সে আবার কী?
হরবোলারা নানারকম পাখি আর জন্তু-জানোয়ারের ডাক মুখ দিয়ে করতে পারে। তারা এইসব ডাক ডেকে লোককে শুনিয়েই রোজগার করে। তোর যখন পড়াশুনা হল না, তখন দোকানে বসেও তুই কিছু করতে পারবি না। হিসেব যে করবি, সে বিদ্যেও তো তোর নেই। তাই তোকে আমার কোনও কাজে লাগবে না।
সুজন সেই থেকে হরবোলা হবার চেষ্টায় লেগে গেল। তার কাজ মাঠে ঘাটে বনবাদাড়ে ঘোরা, আর পাখির ডাক শুনে, জানোয়ারের ডাক শুনে, সেই ডাক মুখ দিয়ে নকল করা। এই কাজে তার ক্লান্তি নেই, কারণ তার স্বাস্থ্য বেশ ভাল, অনেক হাঁটতে পারে, গাছে চড়তে পারে, সাঁতার কাটতে পারে। তার ডাকে যখন পাখি উত্তর দেয়, তখন তার মনটা নেচে ওঠে। মনে হয় সব পাখিই তার বন্ধু। ভোলা মাঠে গিয়ে বসে গোরু বাছুর ছাগল ভেড়ার ডাক সে তুলেছে, তারা তার ডাকে জবাব দেয়। তার হাম্বা ডাক শুনে নিস্তারিণী বুড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ধবলীর বাছুরটা হঠাৎ ফিরে এল ভেবে; তার গাধার ডাক শুনে। মোতি ধোপার গাধা ঘাড় তুলে কানখাড়া করে ডাকতে শুরু করে, মোতি ভাবে আরেকটা গাধা এল কোত্থেকে! ঘোড়ার চিহিতেও সুজন ওস্তাদ, সেটা সে ডাকে জমিদার হালদারের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে। সে ডাক শুনে সহিস করিম মিঞা ভাবে, কই, আমার ঘোড়া তো ডাকছে না–এটা আবার কার ঘোড়া?
পাখির কথাই যদি বলল, তা হলে সুজন অন্তত একশো পাখির ডাক তুলেছে। কাক চিল চড়ই, শালিক, কোয়েল, দোয়েল, পায়রা, ঘুঘু, তোতা, ময়না, বুলবুলি, টুনটুনি, চোখ-গেল, কাদাখোঁচা, কাঠঠোকরা, হুতোম প্যাঁচা–আর কত নাম করব? সুজন এইসব পাখির ডাক তুলে নিয়েছে এই গত কয়েক বছরে। সে ডাক শুনে পাখিরাই যদি ভুল করে তা হলে মানুষের আর কী দোষ?
বয়স কত হল সুজনের? তা হয়েছে মন্দ কী! তাকে আর খোক বলা যায় না, সে এখন জোয়ান। সে গতরে বেড়েছে, সবল সুস্থ শরীর হয়েছে তার। বাবা বলে, তুই এবার কাজে লেগে পড়। রোজগারের বয়স হয়েছে তোর। কার্তিক হরবোলা থাকে এই পাশের গাঁয়ে। তাকে গিয়ে বল তোর। একটা হিল্লে করে দিতে। না হয় তার সঙ্গে রইলি কটা দিন; তারপর আরেকটু বয়স হলে নিজের পথ দেখবি।
বাপের কথা শুনে সুজন কার্তিক হরবোলার সঙ্গে গিয়ে দেখা করে। কার্তিকের বয়স হয়েছে দুকুড়ির উপরে–সে বিশ বছর হরবোলার কাজ করছে। কিন্তু সুজন দেখল সে নিজে যতরকম ডাক জানে, কার্তিক তার অর্ধেকও জানে না। সুজন এই কিছুদিন হল নাকিসুরে মুখ দিয়ে সানাই বাজাতে শিখেছে, তার সঙ্গে ডুগি তবলা সে নিজেই বাজায়; শিঙে ফোঁকার আওয়াজও শিখেছে, নাচের সঙ্গে যে ঘুঙুর বাজে সেই ঘুঙুরের আওয়াজ করতে শিখেছে মুখ দিয়ে। কার্তিক এসব কিছুই জানে না। সে সুজনের কাণ্ড দেখে হাঁ! তবে মুখে কিছু বলল না, কারণ কার্তিকের হিংসে হচ্ছিল। সে শুধু বলল, আমি শাগরেদ নিই না। তোমার যা করার তা নিজেই করতে হবে।
সুজন বলল, আজ্ঞে আপনি কী করে শুরু করলেন তা যদি বলেন তা হলে আমার একটু সুবিধে হয়।
তাতে কার্তিকের আপত্তি নেই। সে বলল, আমি তেরো বছর বয়সে যন্তিপুরের রাজবাড়িতে গিয়ে হরবোলার খেলা দেখাই। রাজা খুশি হয়ে আমাকে ইনাম দেন। সেই থেকে আমার নাম হয়ে যায়। তুই কোনও রাজাকে খুশি করতে পারিস তত তোরও একটা গতি হয়ে যাবে। আমার দ্বারা কিছু করা সম্ভব নয়।
সুজন আর কী করে? সে কাউকে চেনে না, কোথাকার কোন রাজবাড়িতে গিয়ে খেলা দেখাবে সে? মনের দুঃখে সে বাড়ি ফিরে এল।
সুজনের গ্রামের নাম হল ক্ষীরা। ক্ষীরার উত্তরে তিন ক্রোশ দূরে একটা বড় মাঠ পেরিয়ে ছিল একটা গভীর বন। এই বনের নাম চাঁড়ালি। চাঁড়ালির বনে যত পাখি আর জানোয়ারের বাস তেমন আর কোনও বনে ছিল না। সুজন একদিন দিন থাকতে থাকতে সেই বনে গিয়ে হাজির হল। জানোয়ারে তার কোনও ভয় নেই, আর পাখিতে তো নেই-ই। এই বনে গিয়ে তিনটে নতুন নাম-না-জানা পাখির ডাক সে তুলল। সূর্যি যখন মাথার উপর থেকে পশ্চিমে নামতে শুরু করেছে, এমন সময় সুজন শুনতে পেল ঘোড়ার খুরের শব্দ, আর দেখল একপাল হরিণ ছুটে পালিয়ে গেল।
কিছু পরেই সুজন দেখল যে, বনের মধ্যে দিয়ে আসছেন ঘোড়ার পিঠে এক রাজা, আর আরও পাঁচ-সাতটা ঘোড়ায় তাঁর অনুচরের দল। দেখে সে কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল, কারণ বনে অন্য মানুষ দেখবে সেটা সে ভাবেনি। এটা সে ভালই বুঝল যে, রাজা মৃগয়ায় বেরিয়েছেন।
এদিকে রাজাও সুজনকে দেখে অবাক!
তুই কে রে? রাজা হাঁক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ঘোড়া থামিয়ে।
সুজন হাতজোড় করে নিজের নাম বলল।
তুই একা ঘুরে বেড়াচ্ছিস, তোর বাঘের ভয় নেই?
সুজন মাথা নেড়ে না বলল।
তার মানে কি এ বনে বাঘ নেই? রাজা জিজ্ঞেস করলেন। শুনেছিলাম যে, চাঁড়ালির বনে অনেক বাঘের বাস?
বাঘ আপনার চাই?
চাই বইকী! শিকারে এসেছি দেখতে পাচ্ছিস না? বাঘ ছাড়া কি শিকার হয়?
বাঘ খুঁজে পাননি আপনারা?
না, পাইনি। হরিণ ছাড়া আর কিছুই পাইনি।