বাবু দোরগোড়ায় এসে থেমে গেছেন দেখে পচা কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখছিল; সাধনবাবু প্রচণ্ড মনের জোর প্রয়োগ করে বিহ্বল ভাবটা কাটিয়ে চাকরকে চা আনতে বললেন।
আর, ইয়ে, আজ কেউ এসেছিল? আমার খোঁজ করতে?
কই না তো।
হুঁ।
সাধনবাবু অবশ্য সন্দেহ করেছিলেন পুলিশ হয়তো এরই মধ্যে হানা দিয়ে গেছে। তাঁর ঘরে খুন হওয়া ব্যক্তির মুণ্ডু পেলে তাঁর যে কী দশা হবে সেটা ভাবতে তাঁর আরেক দফা ঘাম ছুটে গেল।
গরম চা পেটে পড়তে সামান্য বল যেন ফিরে এল মনে। যাক–অন্তত টাইম বোমা তো নয়।
কিন্তু এও ঠিক যে, এই মুণ্ডসমেত মোড়কটিকে সামনে রেখে যদি তাঁকে সারারাত জেগে বসে থাকতে হয় তা হলে তিনি পাগল হয়ে যাবেন।
ঘুমের বড়িতে ঘুম হল ঠিকই, কিন্তু দুঃস্বপ্ন থেকে রেহাই পাওয়া গেল না। একবার দেখলেন মুণ্ডহীন মৌলিকের সঙ্গে বসে তিন-তাস খেলছেন তিনি, আরেকবার দেখলেন মৌলিকের ধড়বিহীন মুণ্ডু তাঁকে এসে বলছে, দাদা,–ওই বাক্সে প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে। দয়া করে মুক্তি দিন আমায়।
বড়ি খাওয়া সত্ত্বেও চিরকালের অভ্যাসমতো সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেল সাধনবাবুর। হয়তো ব্রাহ্ম মুহূর্তের গুণেই সংকট মোচনের একটা উপায় সাধনবাবুর মনে উদিত হল।
মুণ্ডু যখন তাঁর কাছে পাচার করা হয়েছে, তখন সে-মুণ্ডু অন্যত্র চালান দিতে বাধাটা কোথায়? তাঁর ঘর থেকে জিনিসটাকে বিদায় করতে পারলেই তো নিশ্চিন্ত।
ভোর থাকতেই অন্য কাজ সারার আগে বাজারের থলিতে মোড়কটা ভরে নিয়ে সাধনবাবু বেরিয়ে পড়লেন। প্যাকিংটা ভালই হয়েছে বলতে হবে, কারণ ভিতরে রক্ত চুঁইয়ে থাকলেও তার বিন্দুমাত্র বাক্স ভেদ করে বাইরের কাগজে ছোপ ফেলেনি।
বাসে উঠে কালীঘাট পৌঁছতে লাগল পঁচিশ মিনিট। তারপর পায়ে হেঁটে আদিগঙ্গায় পৌঁছে একটি অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি জায়গা বেছে নিয়ে হাতের মোড়কটাকে সবেগে ছুঁড়ে ফেললেন নদীর মাঝখানে।
ঝপাৎ–ডুবুস!
মোড়ক নিশ্চিহ্ন, সাধনবাবু নিশ্চিন্ত।
.
বাড়ি ফিরতে লাগল পঁয়ত্রিশ মিনিট। সদর দরজা দিয়ে যখন ঢুকছেন তিনি, তখন ষোড়শীবাবুর দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে সাতটা বাজছে।
আর সেই ঘড়ির শব্দ শুনেই সাধনবাবু মুহূর্তে চোখে অন্ধকার দেখলেন।
একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেছে তাঁর। কদিন থেকেই বারবার সন্দেহ হয়েছে তিনি যেন কী একটা ভুলে যাচ্ছেন। পঞ্চাশের পর এ জিনিসটা হয়। এ-কথা নীলমণিবাবুকে বলতে তিনি নিয়মিত ব্রাহ্মীশাক খেতে বলেছিলেন।
আজ আধ ঘণ্টা আগেই বেরিয়ে পড়তে হল সাধনবাবুকে, কারণ যাবার পথে একটা কাজ সেরে যেতে হবে।
রাসেল স্ট্রিটে নিলামের দোকান মডার্ন এক্সচেঞ্জে ঢুকতেই একগাল হেসে এগিয়ে এলেন মালিক তুলসীবাবু।
টেবিল ক্লকটা চলছে তো?
ওটা পাঠিয়েছিলেন আপনি?
বা রে, আমি তো বলেইছিলাম পাঠিয়ে দেব। সেটা পৌঁছয়নি আপনার হাতে?
হ্যাঁ, মানে, ইয়ে—
আপনি পাঁচশো টাকা আগাম দিয়ে গেলেন, এত পছন্দ আপনার, আপনি পুরনো খদ্দের কথা দিয়ে কথা রাখব না?
তা তো বটেই, তা তো বটেই—
দেখবেন ফার্স্ট ক্লাস টাইম রাখবে ও ঘড়ি। নামকরা ফরাসি কোম্পানি তো! জিনিসটা জলের দরে পেয়ে গেছেন। ভেরি লাকি!
তুলসীবাবু অন্য খদ্দেরের দিকে এগিয়ে যেতে সাধনবাবু দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন। জলের দরের ঘড়ি জলেই গেল!
ভাল বদলা নিয়েছে মধু মাইতি, তাতে সন্দেহ নেই। আর মডার্নকেই যে মদন শুনেছে ধনঞ্জয়, তাতেও কোনও সন্দেহ আছে কি?
সন্দেশ, কার্তিক ১৩৯০
সুজন হরবোলা
সুজনের বাড়ির পিছনেই ছিল একটা সজনে গাছ। তাতে থাকত একটা দোয়েল। সুজনের যখন আট। বছর বয়স তখন একদিন দোয়েলের ডাক শুনে সে ভাবল–আহা, এ পাখির ডাক কেমন মিষ্টি। মানুষে কি কখনও এমন ডাক ডাকতে পারে? সুজন সেইদিন থেকে মুখ দিয়ে দোয়েলের ডাক ডাকার চেষ্টা। করতে লাগল। একদিন হঠাৎ সে দেখল যে, সে ডাক দেবার পরেই দোয়েলটা যেন তার ডাকের উত্তরে ডেকে উঠল। তখন সে বুঝল যে, এই একটা পাখির ডাক তার শেখা হয়ে গেছে। তার মা দয়াময়ীও শুনে বললেন, বাঃ রে খোকা, মানুষের গলায় এমন পাখির ডাক তো শুনিনি কখনও! সুজন তাতে যারপরনাই খুশি হল।
সুজন দিবাকর মুদির ছেলে। তার একটা বড় বোন ছিল, তার বিয়ে হয়ে গেছে, আর একটা বড় ভাই মারা গেছে তিন বছর বয়সে। সুজন তাকে দেখেইনি। সুজনের মা খুব সুন্দরী, সুজন তার মতো নাক-চোখ পেয়েছে, তার রঙটাও বেশ পরিষ্কার।
দিবাকরের ইচ্ছা ছেলে লেখাপড়া শেখে, তাই সে সুজনকে হারাণ পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করে দিল। কিন্তু পড়াশুনায় সুজনের একেবারেই মন নেই। পাততাড়ি নিয়ে পাঠশালায় বসে থাকে আর এ-গাছ সে-গাছ থেকে পাখির ডাক শুনে মনে মনে ভাবে এসব ডাক সে গলায় তুলবে। গুরুমশাই পাঁচের নামতা বলতে বললে সুজন বলে, পাঁচেকে পাঁচ, পাঁচ দুগুণে বারো, তিন পাঁচে আঠারো…। গুরুমশাই তাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেন, সেই অবস্থায় সুজন শালিক বুলবুলি চোখ-গেল পানকৌড়ির ডাক শোনে আর ভাবে কখন সে পাঠশালা থেকে ছুটি পেয়ে এইসব পাখির ডাক নকল করতে পারবে।
তিন বছর পাঠশালায় পড়েও যখন কিছু হল না তখন একদিন হারাণ পণ্ডিত দিবাকরের দোকানে গিয়ে তাকে বলল, তোমার ছেলের ঘটে বিদ্যা প্রবেশ করানো শিবের অসাধ্য। আমি বলি কি, তুমি ছেলেকে ছাড়িয়ে নাও। তোমার কপাল মন্দ, নইলে তোমার এমন ছেলে হবে কেন? অনেক ছেলেই তো দিব্যি লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে যাচ্ছে।