কিন্তু তাও পচা হাজির।
বাবু, ডাকলেন?
ইয়ে—
কিন্তু কাজটা কি ভাল হবে? সাধনবাবু ভেবেছিলেন পচাকে বলবেন পার্সেলে কান লাগিয়ে দেখতে টিকটিক শব্দ শোনা যাচ্ছে কিনা। টাইম-বোমার সঙ্গে কলকজা লাগানো থাকে, সেটা টিকটিক শব্দে চলে। সেই টিকটিক-ই একটা পূর্বনির্ধারিত বিশেষ মুহূর্তে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে পরিণত হয়।
পচা যখন কান লাগাবে, তখনই যদি বোমাটা—
সাধনবাবু আর ভাবতে পারলেন না। এদিকে পচা বাবুর আদেশের জন্য দাঁড়িয়েই আছে; সাধনবাবুকে বলতেই হল যে তিনি ভুল করে ডেকেছিলেন, তাঁর কোনও প্রয়োজন নেই।
.
এই রাতটা সাধনবাবু ভুলবেন না কোনওদিন। অসুখ বিসুখে রাত্রে ঘুম হয় না এটা স্বাভাবিক নয়, কিন্তু চরম আতঙ্কে এই শীতকালে ঘর্মাক্ত অবস্থায় সারারাত ঠায় বিছানায় বসে কাটানোর অভিজ্ঞতা তাঁর এই প্রথম।
কিন্তু সকাল পর্যন্ত যখন বোমা ফাটল না, তখন কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে সাধনবাবু স্থির করলেন যে আজই সন্ধ্যায় মোড়কটা খুলে দেখতে হবে তার মধ্যে কী আছে। তাঁর নিজেরও মনে হয়েছে যে তাঁর সন্দেহটা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু সন্ধ্যাবেলা এমন একটা ঘটনা ঘটল যে, সাধনবাবুর আর মোড়ক খোলা হল না।
অনেক লোক আছে যারা খবরের কাগজের আদ্যোপান্ত না পড়ে পারে না। সাধনবাবু এই দলে পড়েন না। প্রথম এবং মাঝের পাতার খবরগুলোর শিরোনামায় চোখ বুলিয়েই তাঁর কাগজ পড়া হয়ে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাই উত্তর কলকাতায় খুনের খবরটা তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। আপিস থেকে ফিরে একতলায় নবেন্দু চাটুজ্যের ঘরে একটা বড়রকম দাপাদাপি চলছে শুনে কারণ জিজ্ঞেস করে তিনি ঘটনাটা জানতে পারলেন।
পটুয়াটোলা লেনে খুন, হত ব্যক্তির নাম শিবদাস মৌলিক। কথাটা শুনেই সাধনবাবুর একটা সুপ্ত স্মৃতি খোঁচা খেয়ে জেগে উঠল।
এক মৌলিককে তিনি চিনতেন খুব ভাল করে। তার প্রথম নাম শিবদাস কী? হতেও পারে। সাধনবাবু তখন থাকতেন ওই পটুয়াটোলা লেনেই। মৌলিক ছিল তাঁর প্রতিবেশী। তিন-তাসের আড্ডা বসত মৌলিকের ঘরে রোজ সন্ধ্যায়। মৌলিককে কেন জানি মৌলিক বলেই ডাকত সবাই। আরও দুজন ছিলেন আড্ডায়। সুখেন দত্ত আর মধুসূদন মাইতি। এই দ্বিতীয় ব্যক্তিটির মতো সাংঘাতিক চরিত্র সাধনবাবু আর দেখেননি। তাসের খেলায় সে যে জুয়াচুরির রাজা, সে সন্দেহ সাধনবাবুর গোড়া থেকেই হয়েছিল। শেষে বাধ্য হয়ে একদিন সন্দেহটা প্রকাশ করতে হল। এতে মধু মাইতির প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ভয়াবহ। তার পকেটে সবসময়ই যে একটি চাকু অবস্থান করে সেটা সেদিনই জানতে পেরেছিলেন সাধনবাবু। তিনি প্রাণে বেঁচেছিলেন মৌলিক আর সুখেন দত্তর জন্য। ব্যবসায় উন্নতির পর সাধনবাবু পটুয়াটোলা লেনের ভোলার ঘর ছেড়ে চলে আসেন মির্জাপুর স্ট্রিটের এই ফ্ল্যাটে। আর সেই থেকেই মৌলিক অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে তাঁর যোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাসের নেশাটা তিনি ছাড়াতে পারেননি, আর সেইসঙ্গে তাঁর সন্দেহ বাতিকটাও। কিন্তু অন্য দিক দিয়ে পরিবর্তন হয়েছিল বিস্তর। পোশাকে পারিপাট্য, বিড়ি ছেড়ে উইলস সিগারেট ধরা, নিলামের দোকান থেকে মাঝে মাঝে শখের জিনিস কিনে এনে ঘর সাজানো-পেন্টিং, ফুলদানি, বাহারের অ্যাশট্রে–এ সবই গত পাঁচ-সাত বছরের ঘটনা।
এই খুনের ঘটনার শিবদাস মৌলিক যদি সেই মৌলিক হয়, তা হলে খুনি যে মধু মাইতি সে বিষয়ে সাধনবাবুর কোনও সন্দেহ নেই।
খুনটা কীভাবে হল? সাধনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
নৃশংস,বললেন নবেন্দু চাটুজ্যে। লাশ শনাক্ত করার কোনও উপায় ছিল না। পকেটে একটা ডায়রি থেকে নাম জেনেছে।
কেন, কেন? শনাক্ত করার উপায় ছিল না কেন?
ধড় আছে, মুড়ো নেই। শনাক্ত করবে কী করে?
মুড়ো নেই মানে? মুণ্ডু ঘ্যাচাং! জোড়া হাত মাথার উপর তুলে আবার ঝটিতি নামিয়ে এনে খাঁড়ার কোপের অভিনয় করে বুঝিয়ে দিলেন নবেন্দু চাটুজ্যে। খুনি যে কোথায় সরিয়ে রেখেছে মুণ্ডু সেটা এখনও জানা যায়নি।
খুনি কে সেটা জানা গেছে?
তিন-তাসের বৈঠক বসত এই মৌলিকের ঘরে। তাদেরই একজন বলে সন্দেহ করছে পুলিশ। সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠতে উঠতে সাধনবাবু অনুভব করলেন যে তাঁর মাথাটা ঝিমঝিম করছে। সেদিনের ঘটনা চোখের সামনে জলজ্যান্ত দেখতে পাচ্ছেন তিনি–যেদিন তিনি মধু মাইতিকে জোচ্চুরির অপবাদ দিয়েছিলেন। চাকুর আক্রমণ থেকে তিনি রেহাই পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তার বেশ কিছুক্ষণ পর অবধি মধু মাইতির দৃষ্টি তাঁর উপর অগ্নিবর্ষণ করেছিল সেটা মনে আছে। আর মনে আছে মধুর একটি উক্তি–আমায় চেনো না তুমি, সাধন মজুমদার!–আজ পার পেলে, কিন্তু এর বদলা আমি নেব, সে আজই হোক, আর দশ বছর পরেই হোক।
রক্ত-জল-করা শাসানি। সাধনবাবু ভেবেছিলেন পটুয়াটোলা লেন থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন, কিন্তু কিন্তু ওই মোড়ক যদি মধু মাইতি দিয়ে গিয়ে থাকে? মদন!ধনঞ্জয় বলেছিল মদন। ধনঞ্জয় যে কানে খাটো সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। মধু আর মদনে খুব বেশি পার্থক্য আছে কি? মোটেই না। মধু অথবা মধুর লোকই রেখে গেছে ওই পার্সেল, আর সেটা যাতে সত্যিই তাঁর হাতে পৌঁছয় তাই চিরকুটে সই করিয়ে নিয়েছে।
ওই মোড়কের ভিতরে রয়েছে শিবদাস মৌলিকের মাথা!
এই সন্দেহ সিঁড়ির মাথা থেকে তাঁর ঘরের দরজার দূরত্বটুকু পেরোবার মধ্যে দৃঢ়ভাবে সাধনবাবুর মনে গেঁথে গেল। দরজা থেকেই দেখা যায় টেবিলের উপর ফুলদানিটার পাশে রাখা মোড়কটাকে। মোড়কের ওজন এবং আয়তন দুইই এখন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছে তার ভিতরে কী আছে।