আসলে সতেরোর দুই মির্জাপুর স্ট্রিটের এই ফ্ল্যাটবাড়ির সকলেই সাধনবাবুর সন্দেহ বাতিকের কথা জানেন, এবং আড়ালে এই নিয়ে হাসিঠাট্টা করেন। আজ কী কী সন্দেহের উদয় হল আপনার মনে? এ জাতীয় প্রশ্ন দিনের শেষে সাধনবাবুকে প্রায়ই শুনতে হয়।
শুধু প্রশ্ন নয়, অন্যভাবেও তাঁকে নিয়ে লেগ-পুলিং চলে। একতলার নবেন্দু চাটুজ্যের ঘরে সন্ধ্যায় তিন-তাসের আড্ডা বসে। সাধনবাবু তাতে নিয়মিত যোগদান করেন। সেদিন যেতে নবেন্দুবাবু তাঁকে একটা দলা পাকানো কাগজ দেখিয়ে বললেন, দেখুন তো মশাই, এ থেকে কিছু সন্দেহ হয় কি না। এটা জানলা দিয়ে ফেলে দিয়ে গেছে।
আসলে কাগজটা নবেন্দুবাবুরই মেয়ে মিনির অঙ্কের খাতার একটা ছেঁড়া পাতা। সাধনবাবু কাগজটাকে খুলে সেটার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বললেন, এটা তো সংখ্যা দিয়ে লেখা কোনও সাংকেতিক ভাষা বলে মনে হচ্ছে।
নবেন্দুবাবু কিছু না বলে চুপটি করে চেয়ে রইলেন সাধনবাবুর দিকে।
কিন্তু এটার তো মনে করা দরকার, বললেন সাধনবাবু। ধরুন এটা যদি কোনও হুমকি হয়, তা হলে…
সংকেতের পাঠোদ্ধার হয়নি অবশ্য। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়; কথা হল, এই কাগজের দলা থেকে সাধনবাবুর সন্দেহ কোন কোন দিকে যেতে পারে সেইটে দেখা। সাধনবাবু বিশ্বাস করেন যে, গোটা কলকাতা শহরটাই হল ঠক জুয়াচোর ফন্দিবাজ মিথ্যেবাদীর ডিপো। কারুর উপর ভরসা নেই, কাউকে বিশ্বাস করা চলে না। এই অবস্থায় একমাত্র সন্দেহই মানুষকে সামলে চলতে সাহায্য করতে পারে।
এই সাধনবাবুই একদিন আপিস থেকে এসে ঘরে ঢুকে তাঁর টেবিলের উপর একটা বেশ বড় চার-চৌকো কাগজের মোড়ক দেখতে পেলেন। তাঁর প্রথমেই সন্দেহ হল সেটা ভুল করে তাঁর ঘরে চলে এসেছে। এহেন মোড়ক তাঁকে কে পাঠাবে? তিনি তো এমন কোনও পার্সেল প্রত্যাশা করেননি।
কাছে গিয়ে যখন দেখলেন যে মোড়কের উপর তার নাম নেই, তখন সন্দেহটা আরও পাকা হল।
এটা কে এনে রাখল রে? চাকর পচাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন সাধনবাবু।
আজ্ঞে, একজন লোক ধনঞ্জয়ের হাতে দিয়ে গেছে দুপুরে এসে। আপনার নাম করে বলেছে আপনারই জিনিস।
ধনঞ্জয় একতলার ষোড়শীবাবুর চাকর।
কী আছে এতে, কে পাঠিয়েছে, সেসব কিছু বলেছে?
আজ্ঞে, তা তো বলেনি।
বোঝো!
সাধনবাবু কাঁধের চাদরটা আলনায় রেখে খাটে বসলেন। রীতিমতো বড় মোড়ক। প্রায় একটা পাঁচ নম্বর ফুটবল ঢুকে যায় ভিতরে। অথচ কে পাঠিয়েছে জানার কোনও উপায় নেই।
সাধনবাবু খাট থেকে উঠে এগিয়ে গিয়ে মোড়কটা হাতে তুললেন। বেশ ভারী। কমপক্ষে পাঁচ কিলো।
সাধনবাবু মনে করতে চেষ্টা করলেন শেষ কবে তিনি এই জাতীয় মোড়ক পেয়েছেন। হ্যাঁ, বছর তিনেক আগে খড়দায় তাঁর এক মাসিমা থাকতেন, তিনি পাঠিয়েছিলেন আমসত্ত্ব। তার মাস ছয়েকের মধ্যেই সেই মাসিমার মৃত্যু হয়। আজ সাধনবাবুর নিকট আত্মীয় বলতে আর কেউই অবশিষ্ট নেই। পার্সেল কেন, চিঠিও তিনি মাসে দু-একটার বেশি পান না। এই মোড়কের সঙ্গে একটা চিঠি থাকা অস্বাভাবিক হত না, কিন্তু তাও নেই।
কিংবা হয়তো ছিল। সাধনবাবুর সন্দেহ হল ধনঞ্জয়ের অসাবধানতা হেতু সেটি খোয়া গেছে।
একবার ধনঞ্জয়ের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
তাকে ডেকে পাঠানো অনুচিত হবে মনে করে সাধনবাবু নিজেই নীচে গেলেন। ধনঞ্জয় উঠোনে বসে হামানদিস্তায় কী যেন হেঁচছিল, সাধনবাবুর ডাকে উঠে এল।
ইয়ে, আজ তোমার হাতে কেউ একটা পার্সেল দিয়ে গোসল আমার নাম করে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
সঙ্গে চিঠি ছিল?
কই না তো।
কোত্থেকে আসছে সেটা বলেছিল?
মদন না কী জানি একটা নাম বললেন।
মদন?
তাই তো বললেন।
মদন নামে কাউকে চেনেন বলে মনে করতে পারলেন না সাধনবাবু। কী বলতে কী বলছে লোকটা কে জানে! ধনঞ্জয় যে একটি গবেট সে সন্দেহ অনেকদিনই করেছেন সাধনবাবু।
চিঠিপত্তর কাগজটাগজ কিছু ছিল না সঙ্গে?
একটা কাগজ ছিল, তাতে বাবু সই করে দিলেন। কে, যোড়শীবাবু? আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু ষোড়শীবাবুকে জিজ্ঞেস করে কোনও ফল হল না। একটা চিরকুটে তিনি সাধনবাবুর হয়ে সই করে দিয়েছেন বটে, কিন্তু সেটা কোথা থেকে এসেছিল খেয়াল করেননি।
সাধনবাবু আবার নিজের ঘরে ফিরে এলেন। কার্তিক মাসের সন্ধ্যা, শীতটা এর মধ্যে বেশ অনুভব করা যাচ্ছে। সামনে কালীপুজো, তার তোড়জোড় যে চলছে সেটা মাঝে মাঝে বোমা-পটকার–
দুম!
পাড়াতেই একটা বোমা ফেটেছে। আর সেই মুহূর্তে খাটে বসা সাধনবাবুর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। টাইম-বোমা!
ওই মোড়কের মধ্যে টাইম-বোমা নেই তো, যেটা নির্দিষ্ট সময়ে ফেটে তাঁর ইহজগতের লীলা সাঙ্গ করে দেবে?
এই টাইম-বোমার কথা ইদানীং খুব শোনা যাচ্ছে। সারা বিশ্বের সন্ত্রাসবাদীদের এটা একটা প্রধান অস্ত্র।
কিন্তু তাঁকে বোমা পাঠাবে কে, কেন?
প্রশ্নটা মনে আসতেই সাধনবাবু উপলব্ধি করলেন যে ব্যবসায়ী হওয়ার ফলে তাঁর শত্রুর অভাব নেই। কনট্র্যাক্ট পাবার জন্য তোষামোদ ধরাধরি তাঁকেও করতে হয়, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীদেরও করতে হয়। যদি তিনি পেয়ে যান সে কনট্র্যাক্ট, তা হলে অন্যেরা হয়ে যায় তাঁর শত্রু। এ তো হামেশাই হচ্ছে।
পচা!
ডাকটা দিয়েই বুঝতে পারলেন যে, তাঁর গলা দিয়ে পরিষ্কার আওয়াজ বেরোচ্ছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।