দেখলেন তো, আলাপটাকে গেঁজে যেতে দিলুম না। ভাল আছেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ–আসুন বসুন। টিভিতে একটা ভাল প্রোগ্রাম ছিল, কিন্তু ত্রিদিববাবুর তাতে আক্ষেপ নেই, কারণ সঞ্জয় লাহিড়ীর আসাটা তিনি পছন্দই করলেন। ত্রিদিববাবু বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসালেন সঞ্জয়বাবুকে।
আজ থেকে তুমিতে চলে গেলে হত না? বললেন সঞ্জয় লাহিড়ী।
তাতে আমার কোনই আপত্তি নেই।
ভেরি গুড। বেশ বাড়ি তোমার। কদিন আছ এখানে?
বছর সাতেক হল। তুমি থাকো কোথায়?
এখান থেকে খুব একটা বেশি দূরে নয়। মিডলটন রো–পঁচিশ নম্বর।
আই সি।
আসছে শনিবার যাচ্ছ কি?
রবীন্দ্রসদনে? ত্রিদিববাবু জিজ্ঞেস করলেন।
হ্যাঁ। ভীমসেন যোশীর গান আর চৌরাসিয়ার বাঁশি।
ইচ্ছে তো আছে যাবার। উদ্যোক্তারা দুখানা টিকিটও পাঠিয়েছেন।
চলো, আর তারপর চলো ক্যালকাটা ক্লাবে খাওয়া যাক–আমরা চারজনে।
আমি তো মেম্বার নই, বললেন ত্রিদিববাবু।
তাতে কী হয়েছে? তোমরা যাবে আমার গেস্ট হয়ে।
তা বেশ তো। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।
তুমি এখনও মেম্বার হওনি কেন? এই বেলা হয়ে পড়ো–দেখবে হয়তো অনেক পুরনো বন্ধুর সাক্ষাৎ পেয়ে যাবে।
তা তো হতেই পারে।
আমার তো তাই হল। তিন-তিনজন স্কুলের বন্ধু। ত্রিশ বছর পর দেখা। আমরা হচ্ছি নাইনটিন সিক্সটির ব্যাচ। মিত্র ইনস্টিটিউশন। সেই সব পুরনো দিনের পুরনো শিক্ষকদের কথা হচ্ছিল।
আরও মিনিট পনেরো থেকে কলকাতার ট্র্যাফিক জ্যাম, লোডশেডিং ইত্যাদি নিয়ে কথা বলে ত্রিদিববাবুর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে চা খেয়ে সঞ্জয়বাবু উঠে পড়লেন।
আমার আবার ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তোমার বাড়ি পথে পড়ল, তাই একবার না এসে পারলুম না। এবার কিন্তু ভাই তোমার আসার পালা–পঁচিশ নম্বর মিডলটন রো। না এলে আমি আর আসছি না।
নিশ্চয়ই যাব।
আসি তা হলে—
গুড নাইট।
ত্রিদিববাবু দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বসবার ঘরে ফিরে এলেন। আশ্চর্য! তাঁর এখনও ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না। তিনিও যে ওই একই স্কুলের একই ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। সঞ্জয় ওরফে ফটিক লাহিড়ী ছিল ক্লাসের পয়লা নম্বর বিচ্ছু, আর ত্রিদিব ব্যানার্জির পরম শত্রু, কারণ ত্রিদিব ওরফে দিবু ছিলেন ভাল ছেলের দলে। কী অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে ফটিকের। এর সঙ্গে কি বন্ধুত্ব করা যায়? বেশ কিছুক্ষণ ভেবে ত্রিদিববাবু স্থির করলেন যে সঞ্জয় আজ আর সেই সঞ্জয় নেই, একেবারে সভ্যভব্য নতুন মানুষ হয়ে গেছে। আর তাকে যখন ত্রিদিববাবুর ভালই লেগেছে, তখন বন্ধুত্বতে কোনও আপত্তি নেই। তবে এটা ঠিক যে ত্রিদিব কখনও বলবেন না যে তিনি সঞ্জয়ের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়তেন। সেই অতীতকে চাপা রাখাই ভাল, আজ যেটা সত্যি সেটাকেই মানতে হবে।
ত্রিদিববাবু টিভিটা চালু করে দিলেন।
আনন্দমেলা, পূজাবার্ষিকী ১৪০২ রচনাকাল: ১২ জুন, ১৯৮৯
———–
সন্দেশ পত্রিকায় নতুন বন্ধু নামে বাবার একটি গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালের জানুয়ারিতে। আর তার ঠিক দেড় বছর পরের এক খসড়া খাত থেকে বেরোল সহযাত্রী। একই চিন্তাধারার ওপর ভিত্তি করে এই দ্বিতীয় গল্পটি লেখার কারণ যে কী হতে পারে, তা আজ অনুমান করা কঠিন। হয়তো লেখার সময় প্রথমটির কথা উনি ভুলে গিয়েছিলেন, এবং ফেয়ার করতে গিয়ে হঠাৎই মনে পড়ে যায়। সেইজন্যই বোধহয় সহযাত্রী অপ্রকাশিত থেকে গেছে।
সন্দীপ রায়
২৭.৭.৯৫
সাধনবাবুর সন্দেহ
সাধনবাবু একদিন সন্ধ্যাবেলা কাজ থেকে ফিরে তাঁর ঘরে ঢুকে দেখলেন মেঝেতে একটা বিঘতখানেক লম্বা সরু গাছের ডাল পড়ে আছে। সাধনবাবু পিটপিটে স্বভাবের মানুষ। ঘরে যা সামান্য আসবাব আছে–খাট, আলমারি, আলনা, জলের কুঁজো রাখার টুল–তার কোনওটাতে এক কণা ধুলো তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড়, ফুলকারি করা টেবিল ক্লথ–সবই তকতকে হওয়া চাই। এতে ধোপার খরচটা বাড়ে, কিন্তু সেটা সাধনবাবু গা করেন না। আজ ঘরে ঢুকেই গাছের ডাল দেখে তাঁর নাক কুঁচকে গেল।
পচা।
চাকর পচা মনিবের ডাকে এসে হাজির।
বাবু, ডাকছিলেন?
কেন, তোর কি সন্দেহ হচ্ছে?
না বাবু, তা হবে কেন?
মেঝেতে গাছের ডাল পড়ে কেন?
তা তো জানি না বাবু। কাক-চড়ুইয়ে এনে ফেলেছে বোধহয়।
কেন, ফেলবে কেন? কাক-চড়ুই তো ডাল আনবে বাসা বাঁধার জন্য। সে ডাল মাটিতে ফেলবে কেন? ঝাড় দেবার সময় লক্ষ করিসনি এটা? না কি ঝাড়ুই দিসনি?
ঝাড়ু আমি রোজ দিই বাবু। যখন দিই তখন এ-ডাল ছিল না।
ঠিক বলছিস?
আজ্ঞে হ্যাঁ, বাবু।
তাজ্জব ব্যাপার তো!
পরদিন সকালে আপিস যাবার আগে একটা চড়ুইকে তাঁর জানলায় বসতে দেখে সাধনবাবুর সন্দেহ হল ইনিই বাসা বাঁধার ফিকির খুঁজছেন। কিন্তু কোথায়? ঘরের মধ্যে জায়গা কোথায়? ঘুলঘুলিতে কি? তাই হবে।
তিনতলা ফ্ল্যাটবাড়ির সাতখানা ঘরের মধ্যে তাঁর ঘরের দিকেই চড়ুই-এর দৃষ্টি কেন, এই নিয়েও সাধনবাবুর মনে খটকা লাগল। এমন কিছু আছে কি তাঁর ঘরে, যা পাখিদের অ্যাট্রাক্ট করতে পারে?
অনেক ভেবে সাধনবাবুর সন্দেহ হল–ওই যে নতুন কবরেজি তেলটা তিনি ব্যবহার করছেন–যেটা দোতলার শখের কবিরাজ নীলমণিবাবুর মতে খুসকির মহৌষধ–সেটার উগ্র গন্ধই হয়তো পাখিদের টেনে আনছে। সেইসঙ্গে এমনও সন্দেহ হল যে, এটা হয়তো নীলমণিবাবুর ফিচলেমি, সাধনবাবুর ঘরটাকে একটা পক্ষিনিবাসে পরিণত করার মতলবে তিনি এই তেলের গুণগান করছেন।…