জানি, মাথা হেঁট করে বললেন অক্ষয়বাবু।
এর পরে আর কিছু বলার নেই, তাই অক্ষয়বাবু উঠে পড়লেন। বাড়ি ফিরে ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস বললেন, ফুলঝুরিতে কার গল্প তোর ভাল লাগে রে?
অঞ্জন একটু ভেবে বলল, দুজন আছে–সৈকত ব্যানার্জি আর পুলকেশ দে।
অক্ষয়বাবু ছেলের বইয়ের তাক থেকে একগোছা ফুলঝুরি নিয়ে গিয়ে নিজের খাটের পাশের টেবিলে রাখলেন। তারপর সাতদিন ধরে তিনি রাত্রে খাওয়ার পর এই দুই লেখকের একগুচ্ছ গল্প পড়ে ফেললেন। এদের গল্পের মেজাজ যে তাঁর নিজের গল্পের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এদের বিষয়ও আলাদা, ভাষাও আলাদা।
অক্ষয়বাবু বুঝলেন যে, তাঁকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে। প্রথমে তাঁর নিজের ছেলেকে আরও ভাল করে চিনতে হবে। অঞ্জনকে তিনি চোখের সামনে বড় হতে দেখেছেন, তার সম্বন্ধে গর্ব অনুভব করেছেন, কিন্তু সত্যি কি ছেলের মনের খুব কাছে পৌঁছতে পেরেছেন? অক্ষয়বাবু মিনিটখানেক চিন্তা করেই বুঝলেন তিনি শুধু পারেননি নয়, সে চেষ্টাই করেননি। ছেলে ক্লাসে ফার্স্ট হয় এটা জেনেই তিনি খুশি; ছেলে কী দেখে, কী শোনে, কী পড়ে, কী ভাবে–এসব তিনি কোনওদিন জানতে চেষ্টা করেননি।
ছমাস অক্ষয়বাবু কোনও গল্প লিখলেন না। সেই সময়টাতে ছেলেকে আরও ভাল করে চিনে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। অঞ্জন আধুনিক বিজ্ঞান সম্বন্ধে কিশোরদের জন্য লেখা বহু ইংরিজি বই কিনে পড়ে ফেলেছে। কম্পিউটারের সব খবর তার কাছে আছে, সৌরজগতের গ্রহগুলোর স্যাটিলাইট সম্বন্ধে যা জানা গেছে, সব সে জানে। খেলার ব্যাপারেও অঞ্জনের সমান উৎসাহ। দেশ-বিদেশের ক্রিকেট ফুটবল টেনিস ব্যাডমিন্টন ইত্যাদির খেলোয়াড়দের নাম তার মুখস্থ। অক্ষয়বাবু খবরের কাগজের খেলাধুলোর পাতাটার দিকেই দেখেন না।
অক্ষয়বাবু বুঝলেন এবার থেকে বেশ খানিকটা সময় দিয়ে তাঁকে তাঁর ছেলের জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। গল্পের প্লট ভাবা তিনি অবিশ্যি এখনও থামাননি। কারণ ফুলঝুরিতে তাঁর গল্প ছেপে বেরিয়েছে–এ স্বপ্ন তিনি এখনও দেখেন। একটা গল্পের আইডিয়া মাথায় এলেই তিনি ছেলেকে শোনান।
কেমন হয়েছে বল তো।
একটু একটু করে ইমপ্রুভ করছে, বলে অঞ্জন।
অক্ষয়বাবু যে ক্রমশ তাঁর ছেলের মনের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন সেটা মাঝে মাঝে তাঁর কথায় প্রকাশ পায়। যেমন, একদিন তিনি রাত্রে খাবার টেবিলে বসে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, বেকার, লেন্ডন, ম্যাকেনরো–এই তিনজনের মধ্যে তোর মতে কে শ্রেষ্ঠ?
ম্যাকেনরো, বলল অঞ্জন, তারপর বেকার, তারপর লেন্ডন।
আরেকদিন অক্ষয়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, ফ্যাক্স কাকে বলে জানিস?
জানি।
কী বল তো?
ফ্যাক্সের সাহায্যে পৃথিবীর যে-কোনও জায়গা থেকে যে-কোনও জায়গায় একটা কাগজে কিছু। লিখে বা এঁকে পাঠালে সেটা এক সেকেন্ডের মধ্যে পৌঁছে যায়।
অক্ষয়বাবু বুঝলেন ছেলেকে নতুন কোনও জ্ঞান তিনি দিতে পারবেন না। তিনি যা জানেন, ছেলে তার চেয়ে বেশি জানে। তবে এটা ঠিক যে তিনি ছেলেকে এখন আগের চেয়ে ঢের বেশি ভাল করে চেনেন।
তা হলে কি আবার গল্প লেখা শুরু করা যায়?
তিনি কথাটা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন। অঞ্জন বলল, লেখো না। অবিশ্যি ছাপার মালিক হলেন সুনির্মলবাবু। গল্প ভাল হলে উনি নিশ্চয়ই ছাপবেন।
এবার না ছাপলে কিন্তু মরমে মরে যাব। বললেন অক্ষয়বাবু। অন্তত একবার সূচিপত্রে আমার নামটা দেখতে চাই।
অঞ্জন কিছু মন্তব্য করল না। দিন সাতেক মাথা খাটিয়ে অক্ষয়বাবু ডানপিটে নামে একটা গল্প লিখে ফেললেন। তারপর সেটা ছেলেকে পড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন হয়েছে?
অঞ্জন বলল, পাঠিয়ে দাও। আমি কপি করে দিচ্ছি।
পরদিন লেখাটা পেয়ে তৎক্ষণাৎ ফুলঝুরির আপিসে গিয়ে সেটা নিজের হাতে দিয়ে এলেন অক্ষয়বাবু।
পনেরো দিনের মধ্যে সুনির্মল সেনের চিঠি এল। ডানপিটে মনোনীত হয়েছে। আগামী কার্তিকের ফুলঝুরিতে ছাপা হবে।
অক্ষয়বাবু সগর্বে চিঠিটা ছেলেকে দেখালেন। অঞ্জন বলল, ভেরি গুড।
এটা ভাদ্র মাস, তাই আরও দুমাস অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে নতুন উদ্যমে অক্ষয়বাবু আরও গল্পের প্লট ভাবতে লাগলেন। এখন তিনি চাবিকাঠি হাতে পেয়ে গেছেন, তাই ছেলেকে শোনানোর আর কোনও প্রয়োজন নেই।
এই দু মাসটাকে অক্ষয়বাবুর দু বছর বলে মনে হল। অবশেষে কার্তিক মাসের দোসরা অঞ্জনের নামে খয়েরি খামে এল নতুন ফুলঝুরি। ছেলে তখন পাড়ার মাঠে খেলতে গেছে। অক্ষয়বাবু সবে আপিস থেকে ফিরেছেন। তিনি আর ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে খাম থেকে পত্রিকাটা বার করলেন।
প্রথমেই দেখলেন সূচিপত্র।
হ্যাঁ–ডানপিটে রয়েছে তেরোর পাতায়।
সেই পাতায় কাগজটা খুলে অক্ষয়বাবু দেখলেন পাতার উপর দিকে ফুলঝুরির আর্টিস্ট মুকুল গোস্বামীর কাজ–গল্পের নাম, লেখকের নাম, আর গল্পের একটা ঘটনার ছবি।
ছাপার অক্ষরে তাঁর লেখা দেখতে অক্ষয়বাবুর অদ্ভুত লাগছিল। তিনি দশ মিনিটে গল্পটা পড়ে ফেলে বেশ একটু অবাক হলেন। তিনি যা লিখেছেন তার বারো আনাই আছে, কিন্তু নতুন যে চার আনা অংশ–সেটা একেবারে মোক্ষম। তাতে গল্প অনেক গুণে ভাল হয়ে গেছে। সুনির্মল সেনের বাহাদুরি আছে।
এই কথাটা ভদ্রলোককে না জানিয়ে পারবেন না অক্ষয়বাবু।
পত্রিকাটা আবার খামের মধ্যে পুরে ছেলের পড়ার টেবিলের উপর রেখে একটা ট্যাক্সি নিয়ে অক্ষয়বাবু সোজা চলে গেলেন ফুলঝুরির আপিসে।