সেজোকাকা ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পর পর তিনবার এফ. এ. পরীক্ষায় ফেল হবার পর ওঁর বাবা, মানে আমার ঠাকুরদাদা, নিজেই ওঁর পড়াশুনো বন্ধ করে দেন। বলেন, ক্ষেতু, তুই যখন একেবারেই অপদার্থ, তখন তোর এডুকেশনের পেছনে খরচ করা মানে টাক জলে দেওয়া। তবে গলগ্রহ হয়ে থাকতে দেওয়াও তো চলে না! তুই আজ থেকে ভোম্বলের সঙ্গে বাজারে যাবি। শাকসজি মাছ মাংস চিনে নিবি। তারপর থেকে সংসারের বাজারটা তুই-ই করবি। ডোম্বল কাকা হলেন বাবার এক দূরসম্পর্কের ভাই; আমাদের বাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করেছেন, মানুষ হয়েছেন।
সেজোকাকা বেশ কিছুদিন বাজারে গেলেন ভোম্বলকাকার সঙ্গে। তারপর একদিন–সেদিন বাড়িতে লোক খাবে–ঠাকুরদা সেজোকাকার পকেটে দুটো দশ টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বললেন, দেখি তুই কেমন জিনিসপত্তর চিনেছিস। আজ বাজারের ভার তোর ওপর।
সেজোকাকাকে দিয়ে বাজার আর হল না, কারণ কাকার পাঞ্জাবির পকেটে ফুটো, নোট দুখানা বাজারে পৌঁছনোর আগেই পথে কোথায় গলে পড়েছে। এর পর থেকে কে আর কাকাকে ট্রাস্ট করবে?
আমার প্রথম স্মৃতিতে সেজোকাকার বয়স তেত্রিশ আর আমার তিন। কালীপুজোর দিন সন্ধ্যাবেলা। ঘটনাটা মনে আছে কেন, সেটা আরেকটু বললেই বোঝা যাবে। সেজোকাকা বারান্দার মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছেন, আর আমি তাঁর পিঠে চড়ে ঘোড়া-ঘোড়া খেলছি। পাশের বাড়ি থেকে হঠাৎ একটা জ্বলন্ত উড়নতুবড়ি এসে বারান্দার তক্তপোশের উপর পড়তেই সর্বনাশ বলে সেজোকাকা সটান উঠে দাঁড়ালেন। তার ফলে আমি পিঠ থেকে ছিটকে পড়লাম শান বাঁধানো মেঝেতে, আর সঙ্গে সঙ্গে মাথা ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। সেদিন অবিশ্যি সেজোকাকাকে ভয়ংকর সব কথা শুনতে হয়েছিল বাড়ির প্রায় সকলের কাছ থেকেই। আমার কিন্তু একটু দুঃখ হয়েছিল কাকার জন্য। কেউ তাঁকে গ্রাহ্য করে না, এমনকী মানুষের মধ্যেই ধরে না, তাই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমার কাকার উপর একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল। মাঝারি হাইট, মাঝারি রঙ, মুখে সবসময়ই একটা খুশি আর দুঃখ মেশানো ভাব–মনে হত সব মানুষেরই বুদ্ধি হবে, সব মানুষই করিৎকর্মা হবে, তার কী মানে? শহরভর্তি এত লোকের মধ্যে একটা লোক যদি সেজোকাকার মতো হয় তাতে দোষ কী?
আমি তাই ফাঁক পেলেই তাঁর একতলার কোণের ঘরটায় গিয়ে সেজোকাকার সঙ্গে বসে গল্প করতাম। কদিন গিয়েই এটা বুঝেছিলাম যে সেজোকাকাকে গল্প বলতে বলে কোনও লাভ নেই, কারণ তাঁর কোনও গল্পই শেষ পর্যন্ত মনে থাকে না।
তারপর কী হল সেজোকাকা?
তারপর? হুঁ…তারপর… দাঁড়া, তারপর…তারপর…তারপর…
গলার স্বর তারপর তারপর বলতে বলতে ক্রমে দম ফুরানো হারমোনিয়ামের মতো ক্ষীণ হয়ে আসে। সেজোকাকা গল্প থেকে গুনগুন বেসুরো গানে চলে যান, শেষটায় গানও ফুরিয়ে গিয়ে কাকার মাথাটা ঘুমে ঢুলতে থাকে। বুঝতে পারি গল্পের বাকি অংশ মনে করার মেহনত কাকার পোষাচ্ছে না। তাঁকে সেই অবস্থায় রেখেই আমি পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি, সেজোকাকা আর ডাকেনও না।
আমার যখন বছর বারো বয়স তখন একদিন তাঁর ঘরে গিয়ে দেখি তিনি একটা মোটা বই খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। জিজ্ঞেস করাতে বললেন আয়ুর্বেদের বই।
বললাম, ও বই পড়ে কী হবে সেজোকাকা?
কাকা একটু ভেবে গম্ভীর ভাবে বললেন, এটাও তো একটা ব্যারাম, তাই না?
কোনটা?
এই যে আমার দ্বারা কিচ্ছু হচ্ছে না, কিচ্ছু মনে থাকে না, কিচ্ছু মাথায় ঢোকে না–এটা নিশ্চয়ই একটা রোগ?
কী আর বলব? বললাম, তা তো হতেই পারে, সেজোকাকা।
তা হলে এর চিকিৎসা হবে না কেন?
বললাম, তুমি নিজেই চিকিৎসা করবে নাকি?
আমি জানতাম যে সেজোকাকার এই অপদার্থতার জন্য তাঁকে ডাক্তার দেখানোর কথা কেউ কোনওদিন ভাবেনি। সত্যি বলতে কি, ওঁর ছেলেবেলার সেই একগাদা ব্যারামের পর ওঁর আর বিশেষ কোনও অসুখটসুখ করেনি। স্বাস্থ্যটা ওঁর মোটামুটি ভালই ছিল।
সেজোকাকা বলে চললেন, চকবাজারে ফুটপাথে বইটা পড়ে ছিল, দশ আনা দিয়ে কিনে এনেছি। বোধহয় কাজে দেবে। মনে হচ্ছে আমার ব্যারামের জন্যও আয়ুর্বেদী চিকিৎসা আছে।
দুদিন বাদে তখন বর্ষাকাল বিকেলে সেজোকাকার ঘরে গিয়ে দেখি উনি বেরোবার তোড়জোড় করছেন। পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো, মালকোঁচা মেরে পরা ধুতি, গলায় জড়ানো সুতির চাদর আর হাতে ছাতা। বললেন, ভটচাপাড়ায় ভাঙা শিবমন্দিরটার পিছনে একটা গাছ আছে খবর পেয়েছি। তার শিকড় আমার চাই। ওইটে পেলেই ব্যস্ নিশ্চিন্তি।
সেজোকাকা বেরিয়ে পড়লেন। আকাশ ঘোলাটে হয়ে আসছে, তেমন তেমন বৃষ্টি নামলে কাকার প্ল্যান ভেস্তে যাবে।
আমি ঘণ্টাখানেক নীচে ঘুরঘুর করে দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেলাম। দক্ষিণের জানলা দিয়ে সামনের রাস্তা দেখা যায়। বৃষ্টি নামল না। সন্ধে যখন হব হব, তখন দেখি সেজোকাকা ফিরছেন। দুড়দাড় করে নীচে নেমে সদর দরজার মুখে কাকার সঙ্গে দেখা।
পেলে শিকড়?
না রে! ভুল হয়ে গেল। একটা টর্চ নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। জায়গাটা জংলা আর বেজায় অন্ধকার।
কিন্তু ওটা কী?
কাকার কথার মধ্যেই চোখ পড়েছে আমার। খদ্দরের পাঞ্জাবির বুকে লাল রঙের ছোপ।
তাই তো, এটা তো খেয়াল করিনি এতক্ষণ!
পাঞ্জাবি খুলতেই বেরোল একটা জোঁক। ভীম যেমন দুর্যোধনের বুকের রক্ত খেয়েছিল, তেমনই ইনি সেজোকাকার বুকের রক্ত খেয়ে ফুলে ঢোল, টোকা দিতেই টপ করে মাটিতে পড়ে গেল।