কেন কাকা? নিকুঞ্জবাবু ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন।
সেদিন সকালে গীতার একটা শ্লোক আওড়াচ্ছিলাম, ও ব্যাটা আমার ভুল ধরে দিলে। ভুল যদি হয়েই থাকে, সেটা সংশোধন করা কি চাকরের কাজ? ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি? ইচ্ছা করছিল ওর গালে একটা থাপ্পড় মেরে দিই, কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম।
ওই থাপ্পড়টা কখনও মারবেন না কাকা–ওতে ফল খুব গুরুতর হতে পারে। ওর ওপর হাত তোলা একেবারে বারণ। আপনি তার চেয়ে বরং ও কাছাকাছি থাকলে গীতা-টিতা আওড়াবেন না। সবচেয়ে ভাল হয় একেবারে চুপ থাকলে।
নিবারণবাবু গজগজ করতে লাগলেন।
এদিকে নিকুঞ্জবাবুর অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। অনুকূলের জন্য মাসে দু হাজার করে দিতে এখন ওঁর বেশ কষ্টই হচ্ছে। একদিন অনুকূলকে ডেকে কথাটা বলেই ফেললেন।
অনুকূল, আমার ব্যবসায় বড় মন্দা চলেছে।
সে আমি জানি।
তা তো জানো, কিন্তু তোমাকে আমি আর কদ্দিন রাখতে পারব জানি না। অথচ তোমার উপর আমার একটা মায়া পড়ে গেছে।
আমাকে একটু ভাবতে দিন এই নিয়ে।
কী নিয়ে?
আপনার অবস্থার যদি কিছু উন্নতি করা যায়।
সে কি তুমি ভেবে কিছু করতে পারবে? ব্যবসাটা তো আর তোমার লাইনের ব্যাপার নয়।
তবু দেখি না ভেবে কিছু করা যায় কি না।
তা দেখো। কিন্তু সেরকম বুঝলে তোমাকে আবার ফেরত দিয়ে আসতে হবে। এই কথাটা তোমাকে আগে থেকে জানিয়ে রাখলাম।
যে আজ্ঞে।
দুমাস কেটে গেল। আজ আষাঢ় মাসের রবিবার। নিকুঞ্জবাবু বুঝতে পারছেন, টেনেটুনে আর দুটো মাস তিনি অনুকুলের ভাড়া দিতে পারবেন। তারপর তাঁকে মানুষ চাকরের খোঁজ করতে হবে। সত্যি বলতে কি, খোঁজ তিনি এখনই আরম্ভ করে দিয়েছেন। ব্যাপারটা তাঁর মোটেই ভাল লাগছে না। তার উপর আবার সকাল থেকে বৃষ্টি, তাই মেজাজ আরও খারাপ।
খবরের কাগজটা পাশে রেখে অনুকূলকে ডাকতে যাবেন এক পেয়ালা চায়ের জন্য, এমন সময় অনুকূল নিজেই এসে হাজির।
কী অনুকূল, কী ব্যাপার?
আজ্ঞে, একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।
কী হল?
নিবারণবাবু জানলার ধারে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা বর্ষার গান করছিলেন, এমন সময় কথার ভুল করে ফেলেন। আমি ঘর ঝাঁট দিচ্ছিলাম, বাধ্য হয়ে ওঁকে সংশোধন করতে হয়। তাতে উনি আমার উপর খেপে গিয়ে আমাকে একটা চড় মারেন। ফলে আমাকে প্রতিশোধ নিতে হয়।
প্রতিশোধ?
আজ্ঞে হ্যাঁ। একটা হাইভোল্টেজ শক ওঁকে দিতে হয় ওঁর নাভিতে।
তার মানে–?
উনি আর বেঁচে নেই। অবিশ্যি যেই সময় আমি শল্টা দিই, সেই সময় কাছেই একটা জোরে বাজ পড়েছিল।
হ্যাঁ, আমি শুনেছিলাম।
কাজেই মৃত্যুর আসল কারণটা কী, সেটা আপনার বলার দরকার নেই।
কিন্তু—
আপনি চিন্তা করবেন না। এতে আপনার মঙ্গলই হবে।
আর হলও তাই। এই ঘটনার দুদিন পরেই উকিল ভাস্কর বোস নিকুঞ্জবাবুকে ফোন করে জানালেন যে, নিবারণবাবু তাঁর সম্পত্তি উইল করে রেখে গিয়েছেন তাঁর ভাইপোর নামে। সম্পত্তির পরিমাণ হল সাড়ে এগারো লক্ষ টাকা।
আনন্দমেলা, অগ্রহায়ণ ১৩৯৩ (২৪ ডিসেম্বর ১৯৮৬)
অপদার্থ
অপদার্থ কথাটা অনেক লোক সম্বন্ধে অনেক সময়ই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন আমাদের চাকর নবকেষ্ট। নব, তুই একটা অপদার্থ–এই কথাটা ছেলেবেলায় মার মুখে অনেকবার শুনেছি। নব কিন্তু কাজ ভালই করত; দোষের মধ্যে সে ছিল বেজায় ঘুমকাতুরে। দিনের বেলা প্রায়ই একটু টেনে ঘুম। দেওয়ার ফলে বিকেলে চায়ের জলটা চড়াতে চারটের জায়গায় হয়ে যেত সাড়ে চারটে। কাজেই মা যে। তাকে অপবাদটা দিতেন সেটা ছিল রাগের কথা।
কিন্তু সেজোকাকার বেলায় অপদার্থ কথাটা যেরকম লাগসই ছিল সেরকম আর কারুর বেলায় হয়েছে। বলে আমার জানা নেই। সেজোকাকা মানে যাঁর ভালনাম ক্ষেত্রমোহন সেন, ডাকনাম ক্ষেতু। বাবারা ছিলেন পাঁচ ভাই। বাবাই বড়, তারপর মেজো সেজো সোনা আর ছোট। পাঁচের মধ্যে সেজো বাদে আর সকলেই জীবনে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন। বাবা ছিলেন নামকরা উকিল। মেজো সম্মানিত অধ্যাপক, সংস্কৃত আর ইতিহাসে ডবল এম. এ। সোনা ব্যবসা করে কলকাতায় তিনখানা বাড়ি তুলেছিলেন, আর ছোট কালোয়াতি গানে বড়বড় মুসলমান ওস্তাদের বাহবা আর ছত্রিশটা সোনা-রুপোর মেডেল পেয়েছিলেন ধনী সমঝদারদের কাছ থেকে।
আর সেজোকাকা?
তাঁকে নিয়েই এই গল্প, তাই তাঁর কথাটা এককথায় বলা যাবে না।
সেজোকাকার জন্মের মুহূর্তে নাকি ভূমিকম্প হয়েছিল। অনেকের মতে সেই কারণে নাকি তাঁর ঘিলুতে জট পাকিয়ে যায়, আর তাই তাঁর এই দশা। হাম আর চিকেন পক্স একবার না একবার প্রায় সব শিশুদেরই হয়। সেজোকাকার এই দুটো তো হয়েই ছিল, সেইসঙ্গে কোনও-না-কোনও সময় হয়েছিল। হুপিং কাশি, ডিপথিরিয়া, ডেঙ্গু, একজিমা, আসল বসন্ত। শিশু বয়সে সাতবার কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে নীল হয়ে সেজোকাকা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। সাত বছরে সেজোকাকার তোতলামো দেখা দেয়; সাড়ে নয়ে পেয়ারা গাছ থেকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে তোতলামো সেরে যায়। এই পতনের ফলে সেজোকাকার গোঁড়ালি ভেঙে যায়। ডাক্তার বিশ্বাস সেটাকে ঠিকমতো জোড়া দিতে না পারায় সেজোকাকাকে সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটতে হত। এই খোঁড়ানোর জন্য তাঁর আর খেলাধুলা করা সম্ভব হয়নি। হাতের টিপের অভাবে ক্যারম, আর মাথা খেলে না বলে তাসপাশাও হয়নি।