ঘরের দরজার সামনে পৌঁছে অনাথবাবু বললেন, চলুন।
দরজাটা ভেজানো ছিল। আমি হাত দিয়ে ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। তারপর দুপা এগিয়ে মেঝের দিকে চোখ পড়তেই আমার সমস্ত শরীরে একটা বিস্ময় ও আতঙ্কের শিহরণ খেলে গেল।
বুট জুতো পরা ও কে পড়ে আছে মেঝেতে?
আর বারান্দার দিক থেকে কার অট্টহাসি হালদারবাড়ির আনাচে-কানাচে প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার রক্ত জল করে আমায় জ্ঞানবুদ্ধি-চিন্তা সব লোপ পাইয়ে দিচ্ছে? তা হলে কি?
আর কিছু মনে নেই আমার।
যখন জ্ঞান হল, দেখি ভরদ্বাজ আমার খাটের পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে আছে, আর আমায় হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন ভবতোষ মজুমদার। আমার চোখ খুলতে দেখে ভবতোষবাবু বললেন, ভাগ্যে সিধুচরণ আপনাকে দেখেছিল ও বাড়িতে ঢুকতে, নইলে যে কী দশা হত আপনার জানি না। ওখানে গেসলেন কোন আক্কেলে?
আমি বললাম, অনাথবাবু যে রাত্রে—
ভবতোষবাবু বাধা দিয়ে বললেন, আর অনাথবাবু! কাল যে অতগুলো কথা বললুম সে সব বোধহয় কিছুই বিশ্বাস করেননি ভদ্রলোক। ভাগ্যে আপনিও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে রাত কাটাতে যাননি ও বাড়িতে। দেখলেন তো ওঁর অবস্থা। হলধরের যা হয়েছিল, এঁরও ঠিক তাই। মরে একেবারে কাঠ, আর চোখ ঠিক সেইভাবে চাওয়া, সেই দৃষ্টি, সেই কড়িকাঠের দিকে।..
আমি মনে মনে বললাম, না, মরে কাঠ নয়। মরে কী হয়েছেন অনাথবাবু তা আমি জানি। কালও সকালে গেলে দেখতে পাব তাঁকে–গায়ে কালো কোট, পায়ে বুট জুতো–হালদারবাড়ির পুব দিকের জঙ্গল থেকে নিমের দাঁতন হাতে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসছেন।
সন্দেশ, অগ্রহায়ণ ১৩৬৯
অনুকূল
এর একটা নাম আছে তো? নিকুঞ্জবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ, আছে বইকী!
কী বলে ডাকব?
অনুকূল।
চৌরঙ্গিতে রোবট সাপ্লাই এজেন্সির দোকানটা খুলেছে মাস ছয়েক হল। নিকুঞ্জবাবুর অনেকদিনের শখ একটা যান্ত্রিক চাকর রাখেন। ইদানীং ব্যবসায় বেশ ভাল আয় হয়েছে, তাই শখটা মিটিয়ে নেবার জন্য এসেছেন।
নিকুঞ্জবাবু রোবটটার দিকে চাইলেন। এটা হচ্ছে যাকে বলে অ্যান্ড্রয়েড, অর্থাৎ যদিও যান্ত্রিক, তাও চেহারার সঙ্গে সাধারণ মানুষের চেহারার কোনও তফাত নেই। দিব্যি সুশ্রী দেখতে, বয়স মনে হয় বাইশ-তেইশের বেশি নয়।
কী ধরনের কাজ করবে এই রোবট? জিজ্ঞেস করলেন নিকুঞ্জবাবু। ডেস্কের উলটো দিকের ভদ্রলোক একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, সাধারণ চাকর যা পারে, ও তার সবই পারবে। কেবল রান্নাটা জানে না। তা ছাড়া, ঘর ঝাড়পোঁছ করা, বিছানা পাতা, কাপড় কাঁচা, চা দেওয়া, দরজা-জানলা খোলা বা বন্ধ করা–সবই পারবে। তবে হ্যাঁ–ও যা কাজ করবে সবই বাড়িতে। ওকে দিয়ে বাজার করানো চলবে না, বা পান-সিগারেট আনাতে পারবেন না। আর ইয়ে–ওকে কিন্তু তুমি বলে সম্বোধন করবেন। তুইটা ও পছন্দ করে না।
এমনি মেজাজ-টেজাজ ভাল তো?
খুব ভাল। সে-দিক দিয়ে ট্রাবল আসবে যদি আপনি কোনও কারণে ওর গায়ে হাত তোলেন। আমাদের রোবটরা ওটা একেবারে বরদাস্ত করতে পারে না।
সেটার অবিশ্যি কোনও সম্ভাবনা নেই; কিন্তু ধরুন, যদি কেউ ওকে একটা চড় মারল, তা হলে কী হবে?
তা হলে ও তার প্রতিশোধ নেবে।
কীভাবে?
ওর ডান হাতের তর্জনীর সাহায্যে ও হাই-ভোল্টেজ ইলেকট্রিক শক দিতে পারে।
তাতে মৃত্যু হতে পারে?
তা পারে বইকী! আর আইন এ-ব্যাপারে কিছু করতে পারে না, কারণ রক্ত-মাংসের মানুষকে যে শাস্তি দেওয়া চলে, যান্ত্রিক মানুষকে তা চলে না। তবে এটা বলতে পারি যে, এখনও পর্যন্ত এরকম কোনও কেস হয়নি।
রাত্তিরে কি ও ঘুমোয়?
না। রোবটরা ঘুমোয় না।
তা হলে এতটা সময় কী করে?
চুপ করে বসে থাকে। রোবটের ধৈর্যের অভাব নেই।
ওর কি মন বলে কোনও বস্তু আছে?
ওরা এমন অনেক কিছু বুঝতে পারে, যা সাধারণ মানুষ পারে না। এ গুণটা সব রোবটের যে সমান পরিমাণে থাকে তা নয়; এটা খানিকটা লাকের ব্যাপার। এ গুণটা সময়ে প্রকাশ পায়।
নিকুঞ্জবাবু রোবটটার দিকে ফিরে বললেন, অনুকূল, আমার বাড়িতে কাজ করতে তোমার আপত্তি নেই তো?
কেন থাকবে? ষোলো আনা মানুষের মতো গলায় বলল অনুকূল। তার পরনে একটা নীল ডোরা কাটা শার্ট আর কালো হাফপ্যান্ট, বাঁ পাশে টেরি আর পাট করে আঁচড়ানো চুল, গায়ের রঙ বেশ ফরসা, দাঁতগুলো ঝকঝকে আর ঠোঁটের কোণে সবসময়ই যেন একটা হালকা হাসি লেগে আছে। চেহারা দেখে মনে বেশ ভরসা আসে।
তা হলে চলো।
নিকুঞ্জবাবুর মারুতি ভ্যান দোকানের বাইরেই অপেক্ষা করছিল, অনুকূলের জন্য চেকটা দিয়ে রসিদ নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। তিনি লক্ষ করলেন যে, ভৃত্যের হাঁটাচলা দেখেও সে যে যান্ত্রিক মানুষ, সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই।
নিকুঞ্জবাবু বাড়ি করেছেন সল্ট লেকে। বিয়ে করেননি, তবে বন্ধুবান্ধব কয়েকজন আছে, তারা সন্ধ্যাবেলা আসে তাস খেলতে। তাদের আগে থেকেই বলা ছিল যে, বাড়িতে একটি যান্ত্রিক চাকর আসছে। কেনার আগে অবিশ্যি নিকুঞ্জবাবু খোঁজ নিয়ে নিয়েছিলেন। এই ক মাসে কলকাতার বেশ কিছু উপরের মহলের বাড়িতে রোবট-ভৃত্য বহাল হয়েছে। মানসুখানি, গিরিজা বোস, পঙ্কজ দত্তরায়, মিঃ ছাবরিয়া–সকলেই বললেন তাঁরা খুব স্যাটিসফাইড, এবং তাঁদের চাকর কোনও ট্রাবল দিচ্ছে না। মুখ। খুলতে না খুলতেই ফরমাশ পালন করে আমার জীবনলাল, বললেন মানসুখানি। আমার তো মনে হয় ও শুধু যন্ত্র নয়, ওর মাথার মধ্যে মগজ আছে আর বুকের মধ্যে কলিজা আছে।