এবার দেখতে পেলাম অনাথবাবুকে–প্রাসাদের পুবদিকের জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে আমার দিকে হেঁটে আসছেন। তাঁকে দেখে মোটেই মনে হয় না যে, রাত্রে তাঁর কোনও ভয়াবহ বা অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা হয়েছে।
আমার কাছে এসে হাসতে হাসতে হাতে একটা নিমের ডাল দেখিয়ে বললেন, আর বলবেন না মশাই! আধঘণ্টা বনেবাদাড়ে ঘুরছি এই নিমডালের খোঁজে। আমার আবার দাঁতনের অভ্যেস কিনা।
ফস করে রাত্রের কথাটা জিজ্ঞেস করতে কেমন বাধো বাধো ঠেকল। বললাম, চা এনেছি। এখানেই খাবেন, না বাড়ি যাবেন?
চলুন না, ওই ফোয়ারার পাশটায় বসে খাওয়া যাক।
গরম চায়ে চুমুক দিয়ে একটা তৃপ্তিসূচক আঃশব্দ করে আমার দিকে ফিরে মুচকি হেসে অনাথবাবু বললেন, খুব কৌতূহল হচ্ছে, না?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, হ্যাঁ, মানে, তা একটু–
বেশ। তবে বলছি শুনুন। গোড়াতেই বলে রাখি–এক্সপিডিশন হাইলি সাকসেসফুল। আমার এখানে আসা সার্থক হয়েছে।অনাথবাবু এক মগ চা শেষ করে দ্বিতীয় মগ ঢেলে তাঁর কথা শুরু করলেন :
আপনি যখন আমায় পৌঁছে দিয়ে গেলেন তখন পাঁচটা। আমি বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগে এই আশপাশটা একটু সার্ভে করে নিলুম। অনেক সময় ভূতের চেয়ে জ্যান্ত মানুষ বা জানোয়ার থেকে উপদ্রবের আশঙ্কা বেশি থাকে। যাই হোক, দেখলুম কাছাকাছির মধ্যে সন্দেহজনক কিছু নেই।
বাড়িতে ঢুকে একতলার ঘরগুলোর মধ্যে যেগুলো খোলা হয়েছে সেগুলোও একবার দেখে নিলুম। জিনিসপত্তর তো আর অ্যাদ্দিন ধরে বিশেষ পড়ে থাকার কথা নয়। একটা ঘরে কিছু আবর্জনা, আর আরেকটার কড়িকাঠে গুটি চারেক ঝুলন্ত বাদুড় ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। বাদুড়গুলো আমায় দেখেও নড়ল না। আমিও তাদের ডিসটার্ব করলুম না।
সাড়ে ছটা নাগাদ দোতলার ওই আসল ঘরটিতে ঢুকে রাত কাটানোর আয়োজন শুরু করলুম। একটা ঝাড়ন এনেছিলুম, তাই দিয়ে প্রথমে আরামকেদারাটিকে ঝেডেপুঁছে সাফ করলুম। কদ্দিনের ধুলো জমেছিল তাতে কে জানে?
ঘরের মধ্যে একটা গুমোট ভাব ছিল, তাই জানলাটা খুলে দিলুম। ভূতবাবাজি যদি সশরীরে আসতে চান তাই বারান্দার দরজাটাও ভোলা রাখলুম। তারপর টর্চ ও ফ্লাস্কটা মেঝেতে রেখে ওই বেতঘেঁড়া আরামকেদারাতেই শুয়ে পড়লুম। অসোয়াস্তি হচ্ছিল বেশ, কিন্তু এর চেয়েও আরও অনেক বেয়াড়া অবস্থায় বহুবার রাত কাটিয়েছি, তাই কিছু মাইন্ড করলুম না।
আশ্বিন মাস, সাড়ে পাঁচটায় সূর্য ডুবেছে। দেখতে দেখতে অন্ধকারটা বেশ জমাট বেঁধে উঠল। আর সেইসঙ্গে সেই গন্ধটাও ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমি এমনিতে খুব ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ, সহজে বড় একটা একসাইটেড হই না, কিন্তু কাল যেন ভিতরে ভিতরে বেশ একটা উত্তেজনা অনুভব করছিলুম।
সময়টা ঠিক বলতে পারি না, তবে আন্দাজে মনে হয় নটা কি সাড়ে নটা নাগাদ জানলা দিয়ে একটা জোনাকি ঘরে ঢুকেছিল। সেটা মিনিটখানেক ঘোরাঘুরি করে আবার জানলা দিয়েই বেরিয়ে গেল।
তারপর কখন যে শেয়াল, ঝিঁঝির ডাক থেমে গেছে, আর কখন যে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি সে খেয়াল। নেই।
ঘুমটা ভাঙল একটা শব্দে। ঘড়ির শব্দ। ঢং ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। মিঠে অথচ বেশ জোর আওয়াজ। জাত ঘড়ির আওয়াজ, আর সেটা আসছে বাইরের বারান্দা থেকে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমটা ছুটে গিয়ে সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে আরও দুটো জিনিস লক্ষ করলুম। এক–আমি আরামকেদারায় সত্যিই খুব আরামে শুয়ে আছি। ছেঁড়াটা তো নেইই, বরং উলটে আমার পিঠের তলায় কে যেন একটা বালিশ গুঁজে দিয়ে গেছে। আর দুই–আমার মাথার উপর একটি চমৎকার ঝালর সমেত আস্ত নতুন টানাপাখা, তা থেকে একটি নতুন দড়ি দেয়ালের ফুটো দিয়ে বারান্দায় চলে গেছে, এবং কে জানি সে দড়িতে টান দিয়ে পাখাঁটি দুলিয়ে আমায় চমৎকার বাতাস করছে।
আমি অবাক হয়ে এইসব দেখছি আর উপভোগ করছি, এমন সময় খেয়াল হল অমাবস্যার রাত্তিরে কী করে জানি ঘরটা চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তারপর নাকে এল একটা চমৎকার গন্ধ। পাশ ফিরে দেখি কে জানি একটা আলবোলা রেখে গেছে, আর তার থেকে ভুরভুর করে বেরোচ্ছে। একেবারে সেরা অম্বুরী তামাকের গন্ধ।
অনাথবাবু একটু থামলেন। তারপর আমার দিকে ফিরে হেসে বললেন, বেশ মনোরম পরিবেশ নয় কি?
আমি বললাম, শুনে তো ভালই লাগছে। আপনার রাতটা তা হলে মোটামুটি আরামেই কেটেছে?
আমার প্রশ্ন শুনে অনাথবাবু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আমি আর ধৈর্য রাখতে না পেরে বললাম, তা হলে কি সত্যি আপনার কোনও ভয়ের কারণ ঘটেনি? ভূত কি আপনি দেখেননি?
অনাথবাবু আবার আমার দিকে চাইলেন। এবার কিন্তু আর ঠোঁটের কোণে সে হাসিটা নেই। ধরা গলায় ভদ্রলোকের প্রশ্ন এল, পরশু যখন আপনি ঘরটায় গেলেন, তখন কড়িকাঠের দিকটা ভাল করে লক্ষ করেছিলেন কি?
আমি বললাম, তেমন ভাল করে দেখিনি বোধহয়। কেন বলুন তো?
অনাথবাবু বললেন, ওখানে একটা বিশেষ ব্যাপার রয়েছে, সেটা না দেখলে বাকি ঘটনাটা বোঝাতে পারব না। চলুন।
অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অনাথবাবু কেবল একটি কথা বললেন: আমার আর ভূতের পিছনে ধাওয়া করতে হবে না সীতেশবাবু। কোনওদিনও না। সে শখ মিটে গেছে।
বারান্দা দিয়ে যাবার পথে ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখলাম সেরকমই ভাঙা অবস্থা।