কিন্তু কোথায় বই? বই তো নেই, খাতা। খান ত্রিশেক নানারকমের খাতা, তার মধ্যে দশবারোটা বাঁধিয়ে নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু খাতা খুলল মন্টু। পরিষ্কার ঝকঝকে বাংলা হাতের লেখা, পড়তে কোনও অসুবিধে নেই।
মন্টু খাটের উপর উঠল খাতাটা নিয়ে।
আর পরমুহূর্তেই নেমে আসতে হল।
তার অজান্তে মা উপরে উঠে এসেছেন।
ও ঘরে কী হচ্ছে মন্টু? ওনার জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছ বুঝি?
মন্টু সুবোধ বালকের মতো খাট থেকে নেমে এসে সুটকেসে খাতাটা রেখে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
যাও, নিজের ঘরে যাও। পরের জিনিস ঘাঁটতে নেই। নিজের বই পড়ো গিয়ে যাও।
ছটার একটু পরেই ফিরে এলেন ভদ্রলোক।
রাত্তিরে খাবার সময় মন্টুর মা বাবাকে বেশ খানিকটা অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন তিনি কালই ফিরে যাচ্ছেন।
তোমাদের আতিথেয়তার তুলনা নেই, কিন্তু আমার পক্ষে এক জায়গায় বেশিদিন থাকা পোষায় না।
বাবা-মা যে খবরটা শুনে অখুশি নন এটা মন্টু জানে, যদিও তার নিজের মনটা খারাপ হয়ে গেছে। বাবা বললেন, আপনি কি কলকাতায় যাবেন এখান থেকে?
হ্যাঁ, তবে সেও বেশিদিনের জন্য নয়। সেখান থেকে অন্য কোথাও পাড়ি দেব। কারুর গলগ্রহ হয়ে থেকে অভ্যেস নেই। আমি সেই বাড়ি ছাড়ার পর থেকেই স্বাধীন।
মা বললেন, গলগ্রহ বলছেন কেন, আমাদের তো কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না।
খানিকটা যে হচ্ছিল সেটা মন্টু জানে, কারণ সে এর মধ্যে একদিন বাবাকে বলতে শুনেছে যে এই মাগ্যির বাজারে একজন বাড়তি লোকের পিছনে খরচ অনেক।
এবার মন্টু আর বাবা দুজনেই গেল ভদ্রলোককে স্টেশনে পৌঁছাতে, বাড়ির গাড়িতে করে। মন্টু জানে যে ট্রেন যখন ছাড়ল, তখন অবধি বাবার মনে সন্দেহ আছে যিনি এসে রইলেন এতদিন, তিনি সত্যি করেই মন্টুর দাদু কি না।
.
সাতদিন পর আরেক বৃদ্ধ এসে হাজির হলেন মন্টুদের বাড়িতে। ইনি মন্টুর মায়ের শেতলমামা। এঁকে এর আগে একবারই দেখেছে মন্টু, দিদির বিয়েতে।
সে কী, শেতলমামা, হঠাৎ কী মনে করে?
একটা কর্তব্য সারতে এসেছি রে। একটা নয়, দুটো। নইলে এই বুড়ো বয়সে আজকের দিনে এমনি এমনি কেউ প্যাসেঞ্জার ট্রেনে পাড়ি দেয়? দুপুরে খাব কিন্তু।
নিশ্চয়ই খাবেন। কী খেতে মন চায় বলুন। এখানে সব পাওয়া যায়, কলকাতার মতো নয়।
দাঁড়া দাঁড়া, আগে কাজগুলো সারি।
কাঁধে ঝোলানো থলি থেকে ভদ্রলোক একটা বই বার করলেন।
এ বইয়ের নাম শুনিসনি তো?
মা বইটা হাতে নিয়ে বললেন, কই, না তো।
পুলিন তোদের বলেনি সেটা জানি।
পুলিন?
তোর ছোটমামা! যে লোক কাটিয়ে গেল এখানে পাঁচটা দিন তার নামটাও জানিস নি? এ তারই লেখা বই।
তাঁর বই?
তোরা কোন্ রাজ্যে থাকিস? সেদিন কাগজেও তো নাম বেরিয়েছে। এমন আত্মজীবনী বাংলা সাহিত্যে কটা আছে?
কিন্তু এই নাম তো—
নাম তো ছদ্মনাম। সারা পৃথিবী ঘুরেছে চল্লিশ বছর ধরে, অথচ এতটুকু দম্ভ নেই।
সারা পৃথিবী–?
পুলিন রায়ের মতো অত বড় ভূপর্যটক ভারতবর্ষে আর হয়নি। আর সব নিজের রোজগারে ঘঘারা। খালাসিগিরি থেকে শুরু করে কুলিগিরি, কাঠের মজুরি, খবরের কাগজ বিক্রি, দোকানদারি, লরির ড্রাইভারি–কোনও কাজ সে বাদ দেয়নি। তার অভিজ্ঞতার কাছে গল্প হার মেনে যায়। সে বাঘের কবলে পড়েছে, সাপের ছোবল খেয়েছে, সাহারায় দস্যুদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে এসেছে, জাহাজডুবি থেকে সাঁতরে উঠেছে ম্যাডাগাস্কারের ডাঙায়। থার্টি নাইনে সে ভারতবর্ষ ছেড়ে আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সে বলে বাপের বাড়ির মায়া একবার কাটাতে পারলে সারা পৃথিবীটাই হয়ে যায় নিজের ঘর। সাদা কালো ছোট বড় জংলি সভ্য সব এক হয়ে যায়।
কিন্তু–এসব আমাদের বললেন না কেন?
তোদের মতো ঘরকুনো কূপমণ্ডুক কি এসব কথা বিশ্বাস করত? সে আসল কি নকল তাই তোরা ঠিক করতে পারিসনি, তাকে মামা বলে ডাকতে পারিসনি, আর এত কথা সে বলতে যাবে তোদের?
ইস্–আ বার ডেকে আনা যায় না মামাকে?
উঁহু। পাখি উড়ে গেছে। বললে বলিদ্বীপটা দেখা হয়নি, সেখানে যাবার চেষ্টা করবে। এই বইটা তোদের দিয়ে গেছে। তোদের ঠিক দেয়নি, দিয়েছে দাদুকে। বললে ওর মনটা এখনও কাঁচা, ওতেই ছাপটা পড়বে ভাল। তবে ওর আসল পাগলামোর কথাটা বলিনি এখনও। ওকে পই পই করে বললাম যে আর কটা দিন থেকে যাও, এ বই নিঘাত পুরস্কার পাবে, অ্যাকাডেমি দশ হাজার টাকা দিচ্ছে আজকাল। সে কিছুতেই শুনলে না। বললে টাকা যদি আসে তো মামুদপুরে আমার ভাগনিকে দিয়ে দিয়ো, সে খুব যত্ন নিয়েছে আমার। শুধু মুখে বলা না, কাগজে লিখে দিলে।–এই নে সেই টাকা।
মা শেতলমামার হাত থেকে কামটা নিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে ধরা গলায় বললেন, বোঝে ব্যাপার।
রচনাকাল আষাঢ় ১৩৮৮ (১৯,২০/৭/৮১) সরাসরি আরো বানো বইতে। প্রথম সংস্করণ সেপ্টেম্বর ১৯৮১
অনাথবাবুর ভয়
অনাথবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ ট্রেনের কামরায়। আমি যাচ্ছিলাম রঘুনাথপুর, হাওয়াবদলের জন্য। কলকাতায় খবরের কাগজের আপিসে চাকরি করি। গত কমাস ধরে কাজের চাপে দমবন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল। তা ছাড়া আমার লেখার শখ, দু-একটা গল্পের প্লটও মাথায় ঘুরছিল, কিন্তু এত কাজের মধ্যে কি আর লেখার ফুরসত জোটে? তাই আর সাত-পাঁচ না ভেবে দশদিনের পাওয়া ছুটি আর দিস্তেখানেক কাগজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।