একটা কথা তোমায় বলি, বললেন মন্টুর মা।
কী?
এনার সঙ্গে কিন্তু মায়ের আদল আছে।
তোমার তাই মনে হল?
সেই রকম টিকোলো নাক, চোখের চাহনিও যেন সেইরকম।
আহা, আমি তো বলছি না ইনি তোমার মামা নন। কিন্তু মামা লোকটি কেমন তা তো কিছুই জানি না আমরা। লেখাপড়া করেননি, কোনও ডিসিপ্লিন নেই, ছন্নছাড়া জীবন…। আমার মোটেই। ভাল লাগছে না ব্যাপারটা।
বাবার কথা থামলে পর মন্টু ঘরে ঢুকল। এই ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই মন্টুর ভদ্রলোককে বেশ ভাল লেগে গেছে। বাবার কথাগুলো সে পছন্দ করেনি। হয়তো পয়সাগুলো দেখলে বাবার মনটা ভদ্রলোকের প্রতি একটু নরম হবে।
এই কয়েন উনি দিলেন?
মন্টু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
উনি কি এসব জায়গায় গেছেন বলে বললেন নাকি?
না, তা বলেননি।
তাও ভাল। এ জিনিস কলকাতায় কিনতে পাওয়া যায়। চৌরঙ্গিতে দোকান আছে।
সাড়ে চারটে নাগাদ দোতলা থেকে নেমে এলেন ভদ্রলোক। তারপরেই বাবার সঙ্গে আলাপ হল।
আপনার ছেলের সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গেছে, বললেন ভদ্রলোক।
হ্যাঁ, ও তাই বলছিল।
মায়ের মতো বাবাও ঘন ঘন দৃষ্টি দিচ্ছেন ভদ্রলোকের দিকে।
আমি দেখেছি কম বয়সী ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব চট করে ভাব হয়ে যায়। ভবঘুরেদের বোধহয় ওরাই সবচেয়ে ভাল বোঝে।
আপনি বুঝি সারাজীবনই ঘুরেছেন?
তা ঘুরেছি। এক জায়গায় বসে থাকা ধাতে ছিল না আমার।
আমরা আবার গুছোনো জীবনটাই বুঝি। উদ্দেশ্যহারা ভাবে ঘোরাঘুরি আমাদের পোয় না। রোজগার আছে, সংসারের দায়িত্ব আছে, সন্তানপালন আছে। আপনি তো বিয়ে করেননি?
না।
ভদ্রলোক একটু চুপ করে থেকে বললেন, সুহাসিনীর বোধহয় মনে নেই; ওর এক প্রমাতামহ–আমার এক দাদু–তাঁরও ঠিক এই প্রবৃত্তি ছিল। উনি তেরো বছর বয়সে ঘরছাড়া হন। আমি তো অল্পদিনের জন্য হলেও ফিরেছি। উনি আর একেবারেই ফেরেননি।
মন্টু দেখল বাবা মার দিকে ফিরলেন।
এটা জানতে তুমি?
জানলেও এখন আর মনে নেই, বললেন মা।
বিকেলে চা খাবার পর এক ব্যাপার হল। মন্টুর বন্ধুরা কদিন থেকেই শুনছে যে সোমবার তার এক দাদু আসবে যাকে দাদু বলে চেনার কোনও উপায় নেই। তারা ভারী কৌতূহলী হয়ে এল সেই দাদুকে দেখতে। চার-পাঁচটি দশ বারো বছরের ছেলেকে একসঙ্গে দেখে দাদুও খুব খুশি। সবাইকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন লাঠি হাতে নিয়ে মিত্তিরদের বাড়ি পেরিয়ে মাঠটার একধারে কদম গাছটার তলায় বসে দাদু বললেন, তুয়ারেগ কাদের বলে জানো? সকলেই মাথা নেড়ে না বলল। দাদু বললেন, সাহারা মরুভূমি জানো তো?–সেই সাহারায় তুয়ারেগ বলে একরকম যাযাবর জাতি বাস করে। দরকার হলে তারা দস্যুবৃত্তি করে। সেই তুয়ারেগের কবলে পড়ে একজন লোক কী ভাবে রক্ষা পেয়েছিল বুদ্ধির জোরে সে গল্প বলি তোমাদের।
দাদুর গল্প ছেলের দল মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলে। মন্টু পরে মা-কে বলেছিল, এমন গল্প, ঠিক মনে হয় সব কিছু চোখের সামনে দেখছি।
বাবা কাছেই ছিলেন, বললেন, গল্পের বই পড়ার বাতিক আছে বুঝি ভদ্রলোকের? কোনও এক ইংরিজি পত্রিকায় এ ধরনের একটা গল্প পড়েছি বলে মনে হচ্ছে।
মন্টু বলেছিল ভদ্রলোকের সুটকেসে বই আছে সেটা সে জানে, তবে গল্পের বই কি না জানে না।
তিনদিন তিন রাত চলে এই ভাবে। বাড়ির কোনও কিছু চুরি হল না, ভদ্রলোক কোনও উৎপাত করলেন না, যা দেওয়া হল তাই তৃপ্তি করে খেলেন, কোনও বাড়তি আবদার করলেন না, কোনও বিষয়ে অভিযোগ করলেন না। এ কদিনে বাবার বেশ কয়েকজন উকিল বন্ধু এসেছে মন্টুদের বাড়িতে। এমনিতে বেশি আসে-টাসে না; মন্টু জানে তারা এই দাদু-কি-দাদু-নয় বুড়োকেই দেখতে এসেছে। মা বাবাকে দেখে মনে হয় তারা মোটামুটি বুড়োকে মেনেই নিয়েছেন। বাবাকে তো একদিন বলতেই শুনেছে মন্টু–লোকটা সাদাসিধে এটা বলতেই হবে। বেশি গায়ে পড়ার চেয়ে এই ভাল, তবে এরকম মানুষের বেঁচে থেকে কী লাভ জানি না। আসলে বাড়ি ছেড়ে পালানোর মানে বোঝো তো?–দায়িত্ব এড়ানো। এঁরা পরাশ্রয়ী জীব। সারা জীবনটাই হয়তো এর-ওর ঘাড়ে ভর করে কাটিয়েছে।
মন্টু একবার ছোটদাদু বলে ডেকে ফেলেছিল ভদ্রলোককে, তাতে তিনি শুধু মৃদু হেসে তার দিকে চেয়েছিলেন, কিছু বলেননি। মা কিন্তু মামা বলে ডাকেননি একবারও। মন্টু সে কথা বলাতে মা বলেছেন, তাতে ভদ্রলোক খুব একটা দুঃখ পাচ্ছেন বলে তো মনে হয় না। আর মামা যে ডাকব, তারপর যদি বেরোয় মামা নন, তা হলে কী অপ্রস্তুতের ব্যাপার বল তো।
চারদিনের দিন ভদ্রলোক বললেন আজ একটু বেরোবেন।–নীলকণ্ঠপুর বাস যায় না?
বাবা বললেন তা যায়। বাজার থেকে এক ঘণ্টা অন্তর অন্তর বাস ছাড়ে।
তা হলে ভাবছি জন্মস্থানটা একবার দেখে আসব। ফিরতে অবিশ্যি বিকেল হয়ে যাবে।
খেয়ে যাবেন তো? প্রশ্ন করলেন মন্টুর মা।
নাঃ। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়াই ভাল। ওখানেই হোটেলে কোথাও খেয়ে নেব। ওর জন্য। চিন্তা কোরো না।
নটার মধ্যেই ভদ্রলোক বেরিয়ে পড়লেন।
দুপুরে মন্টু আর লোভ সামলাতে পারল না। ভদ্রলোকের ঘর খালি। ওঁর সুটকেসটায় কী বই আছে সেটা দেখার শখ অনেকদিন থেকেই। বাবা নেই, মা একতলায় বিশ্রাম করছেন; মন্টু গিয়ে ঢুকল ভদ্রলোকের ঘরে।
সুটকেসে তালা নেই। চুরির ভয়টা নেই ভদ্রলোকের সেটা বোঝাই যাচ্ছে।
মন্টু সুটকেসের ডালাটা তুলল।