মহেশ্বর হাসলেন, আর ফেরা! জীবনে আর ফিরতে পারেন কি না দেখুন। পারু ডাকছে। ভেতরের গুহায়। সেখানে ভিডিও চলছে। একবার নেশায় ধরে গেলে আর ফিরতে হচ্ছে না। হিন্দি ছবির নেশা সাংঘাতিক নেশা। আপনার সৃষ্টির মতো। কিছুই নেই অথচ সবই আছে। মায়ার মায়া। কায়ার ছায়া। ভ্রান্তি অথচ ছেড়ে যেতে মহা অশান্তি। চলুন প্রভু। গাত্রোৎপাটন করুন।
পরমেশ্বর উঠে দাঁড়ালেন। আড়ামোড়া ভেঙে বললেন, তুমি দেখছি আমাকেও বখিয়ে ছাড়বে।
আপনাকে বখাবার ক্ষমতা আমার নেই। আর প্রভু, আপনিই তো সব। চোর, জোচ্চর, ভালো, মন্দ, সৎ, অসৎ, সাধু, অসাধু, সবই তো আপনি। গীতায় আপনিই বলেছেন, আমা হইতে সব উথিত হইয়া, আমাতেই লয় প্রাপ্ত হয়। যেমন, জলের বিম্ব, জলেতেই মিলায়।
খুব হয়েছে। চলো। পথ দেখাও।
মহেশ্বর আগে-আগে চলছেন। পেছনে আসছেন পরমেশ্বর। গুহাপথের দেয়ালে নানা বর্ণের পোস্টার সাঁটা। পরমেশ্বর কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করলেন, কৈলাসে কি ছাপাখানা হয়েছে?
কেন প্রভু?
এ সব কী সাঁটিয়েছ!
সিনেমার পোস্টার। বোম্বাই, বাংলা আর তামিলনাড়ু থেকে এসেছে। ফিল্মে আমি যে খুব পপুলার জগদীশ্বর। কতরকম আমার ভূমিকা একবার অবলোকন করুন।
খুবই নিম্ন রুচির পরিচয় মহেশ্বর! তুমি ক্রমশই, ক্রমশই একটি নিকৃষ্ট দেবতা হয়ে যাচ্ছ।
আমার ভক্তরাই এর জন্য দায়ী প্রভু। আমার কিছু করার নেই! বিশ্বনাথে আমার টাকে কলসি কলসি জল আর দুধ ঢালে ধনী ব্যাবসায়ীরা। কী প্রার্থনা শুনবেন? আরও টাকা আরও কালো টাকা চাই। ভোগ চাই। ব্যাভিচার চাই। তুমি একটা বোকা হাঁদা। নিশ্চয়ই তথাস্তু বলো।
কী করব প্রভু! ভক্তের মনোবাঞ্ছা আমাকে পূর্ণ করতেই হয়। সেই রত্নাকরকে দিয়েই শুরু। আমি তো ভোগ করি না। ভোগ করে সেবায়েতরা।
চালিয়ে যাও। চালিয়ে যাও।
পার্বতী ডিভানে শুয়ে ভিডিওতে শোলে দেখছেন। মহেশ্বর আর পরমেশ্বর ঢুকতেই ধড়মড় করে উঠে বসলেন। গব্বর সিং-এর ডায়লগ চলেছে। পরমেশ্বর আসন নিলেন। গম্ভীর মুখ। ম্লান জ্যোতি। মানুষের চেয়ে দেবতার অধঃপতন কী আরও বেশি হল। পার্বতীর বেশ-ভূষার এ কী ছিরি হয়েছে। এ যে বাইজিমার্কা পোশাক। হায় মহেশ্বর। শাসনের অভাবে সংসার যে ভেসে যায় রে বাপ। অবশ্য সংসার তোমার কোনও কালে ছিল না।
পার্বতী নতজানু হয়ে বললেন, প্রভু কেন হেরি বিরস বদন এমন? শরীর স্বাস্থ্য কুশল তো প্রভু! উদরে কোনও গোলমাল উপস্থিত হয়নি তো? জিয়াডিয়াসিস, অ্যামিবায়োসিস ইত্যাদি কোনও পার্থিব ব্যামোর আক্রমণ হয়নি তো প্রভু!
পরমেশ্বর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, তোমার দিকে তাকাতে পারছি না। তোমার পোশাক বড় অশালীন। অশ্লীল তোমার অঙ্গভঙ্গি। উপরন্তু তুমি অতিশয় ফাজিল ও বাচাল হয়েছে। তিলতিল করে তোমাকে আমরা সৃষ্টি করেছিলুম। শক্তির বলয়। শক্তি-পুঞ্জও বলা চলে।
জাতি পুঞ্জ বা যুক্তফ্রন্ট সরকারের গণতন্ত্রের মতো।
চুপ করো দেবলোকের ব্যাপারে পৃথিবীর উপমা টেনে এনো না। তোমাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি।
প্রভু বারে বারে আমাকে অসুর দমনে আপনার আজ্ঞাবাহী হয়ে পৃথিবীতে যেতে হয়।
বেশ তো। দেব কার্যে পৃথিবীতে যাওয়া মানে স্বৈরিনী হয়ে ফিরে আসা? বাঙালকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছ?
প্রভু, আমার আরাধনা যারা করে, সেই ভক্তকূল আমাকে যেভাবে সাজায়, যেভাবে যেরূপে ভজনা করে, আমি দিনে-দিনে ঠিক সেই রকম হয়ে উঠছি। আমার তো কোনও দোষ নেই। দোষ আপনার।
আমার দোষ? তুমি কী বলতে চাইছ রমণী?
প্রভু রমণী নয়। দেবী।
তোমাকে আর দেবী বলতে পারছি না। তুমি এখন লাস্যময়ী রমণী। বলো কোথায় আমার দোষ! যত দোষ, নন্দ ঘোষ।
আপনি আজকাল বড় ভুলে যান। অবশ্য দোষ নেই আপনার। হাজার, হাজার-হাজার বছরের সুদীর্ঘ জীবনের খুঁটিনাটি মনে রাখা সহজ নয়। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মতো বুদ্ধিমান হলে একটা কম্পিউটার বসিয়ে নিতেন। নিজের স্মৃতি আর প্রয়োজন হত না। কম্পিউটারের স্মৃতিতে সব জমা থাকত। মনে আছে প্রভু, সখা কৃষ্ণ হয়ে কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে পার্থকে বলেছিলেন! মানুষকে গীতা পড়তে বলেন। রোজ সকালে শুদ্ধ বস্ত্রে অন্তত একটি অধ্যায়। অথচ নিজের গীতা নিজে একবার উলটে দেখেন না?
কী বলেছিলুম?
বলেছিলেন যে, যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম। মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।। প্রভু, মনে পড়ে? বলেছিলেন, আমার শরণ যারা যে-ভাবেতে লয়, সে ভাবেই পায় মোরে আমি সর্বাশয়।। প্রভু, আপনার বাক্য তো মিথ্যা হতে পারে না। আমি কখনও হেমা, কখনও জয়া, কখনও জীনাত, কখনও রেখা, কখনও লেখা। যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম।
যাদের নাম করলে তারা আবার কোথাকার দেবী? ওই যে প্রভু! সেলুলয়েডের দেবী।
মহেশ্বর একমনে শোলে দেখছিলেন। দুজনের দিকে ফিরে বললেন, কী তখন থেকে শুরু করেছেন? আপনার জগৎ ভুলে যান। দেখুন সেলুলয়েড ওয়াল্ডের বড়িয়া খেল। সব ভুলিয়ে দেয়। জগৎ মায়া। এ আবার মায়ার মায়া। বড় মিষ্টি মোয়া। একেবারে জয়নগর।
পার্বতী উঠে দাঁড়ালেন। মহেশ্বর বললেন, প্রভু কী সেবনের ইচ্ছা? সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। রাত্রি আসন্ন। এক চুমুক অ্যাপেটাইজার হয়ে যাক।
সে আবার কী?